২৭শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১৪ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৮ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী

অভিযোগ
প্রকাশিত মার্চ ২, ২০২৪
ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী

শেখ আসাদুজ্জামান আহমেদ টিটু: বাংলা ভাষা হাজার বছর ধরে এশিয়ার বিশাল জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা। আধুনা পৃথিবীতে বাংলা ভাষা বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানে (আটকে পড়া বাংলাদেশীদের মধ্যে), মিয়ানমারের (পূর্বতন বার্মা) রাখাইন রাজ্যে (পূর্বতন আরাকান) ব্যবহৃত হচ্ছে। এরমধ্যে বাংলাদেশে পেয়েছে রাষ্ট্রীয় ভাষা, ভারতে পেয়েছে প্রাদেশিক ভাষার স্বকৃতী। এই ভাষার জন্য আন্দোলন হয়েছে বিহারের মানভূম, আসামের শিলচর এবং বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়। মানুষ এই ভাষার জন্য বিহারে, পূর্বতন পূর্ব পাকিস্তানে ও আসামে নিজের তাজা রক্ত ঢেলেছে। যা পৃথিবীর একমাত্র দৃষ্টান্ত। বর্তমানে ভাষার জন্য আত্মদানের স্বীকৃতি হিসেবে সারা পৃথিবীতে ২১শে ফেব্রুয়ারী পালন করা হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। উল্লেখ্য ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে প্রোথিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশের ভিত্তি।

হাজার বছর পূর্বেও বাংলা ভাষা নিষিদ্ধ হয়েছিল এই বাংলাতেই। জোরপূর্বক কেড়ে নেওয়া হয়েছে বাঙালির প্রাণের ভাষা বাংলা। দক্ষিণ ভারত থেকে আগত সেন রাজারা তাদের ধর্মগুরুদের ঘৃণ্য পরিকল্পনায় রাজকীয় ফরমান জারি করে – “যারা বাংলা ভাষা বলবে ও শুনবে তারা ‘রৌরব’ নামক নরকে যাবে।” কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় সেই সেন রাজবংশ ইতিহাস হয়ে যায়, আর বাংলা ভাষা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে টিকে আছে আজ অবধি। যদিও ভারতে হিন্দীর আগ্রাসনের মুখে বাংলা ভাষা। তবে আশার কথা হলো “বাংলা পক্ষ” একটি সংগঠন সোচ্চার হয়েছে পশ্চিম বঙ্গে বাংলা ভাষা ও বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠায়। সেন রাজাদের রাজকীয় ফরমান জারির পর হুমকির মুখে পড়ে বাংলা ভাষা। তখন নির্যাতিত ও নিগৃহীত বাঙালি ও বাংলা ভাষার ত্রানকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হন তুর্কি বংশোদ্ভূত উচ্চাভিলাসী সেনানায়ক ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী। অত্যন্ত দক্ষ এই সেনানায়ক ১২০৪ সালে বাংলার প্রবেশদ্বার রাজমহল ও তেলিয়াগড় এড়িয়ে ঝাড়খণ্ডের শ্বাপদশংকুল অরণ্য দিয়ে বাংলায় প্রবেশ করেন। ঝাড়খণ্ডের শ্বাপদশংকুল অরণ্যের মধ্য দিয়ে এত দ্রুতগতিতে অগ্রসর হয়েছিলেন যে তার সাথে মাত্র ১৭ জন সৈনিকই তাকে অনুসরণ করতে পেরেছিলেন। বখতিয়ার খিলজী সরাসরি রাজা লক্ষ্মণসেনের প্রাসাদদ্বারে উপস্থিত হন এবং দ্বাররক্ষী ও প্রহরীদের হত্যা করে প্রাসাদের ভিতরে প্রবেশ করেন। এতে প্রাসাদের ভিতরে হইচই পড়ে যায় এবং লক্ষ্মণসেন দিগ্বিদিক হারিয়ে ফেলে প্রাসাদের পেছনের দরজা দিয়ে নৌপথে বিক্রমপুরে আশ্রয় নেন। ঐতিহাসিকগন বলেন, ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার বিন খিলজীর বাংলা বিজয়ের মাধ্যম দিয়ে সেইদিন শুধু ভূমির বিজয় হয়নি, সাথে মুক্ত হয়েছিলো বাঙ্গালীদের মুখের ভাষা ‘বাংলা’।

ভাষাবিদ দীনেশ চন্দ্র সেন বলেন, “মুসলমান সম্রাটগণ বর্তমান বঙ্গ-সাহিত্যের জন্মদাতা বললে অত্যুক্তি হয় না। বঙ্গ-সাহিত্য মুসলমানদেরই সৃষ্ট, বঙ্গ-ভাষা বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা।” অধ্যাপক ও গবেষক মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান বলেন, “যদি বাংলায় মুসলিম বিজয় ত্বরান্বিত না হতো এবং এদেশে আরো কয়েক শতকের জন্য পূ্র্বের শাসন অব্যাহত থাকতো, তবে বাংলা ভাষা বিলুপ্ত হয়ে যেত এবং অবহেলিত ও বিস্মৃত-প্রায় হয়ে অতীতের গর্ভে নিমজ্জিত হতো।”

মধ্যযুগে মুসলিম শাসকরা বাংলা ভাষাকে দেন রাজকীয় মর্যাদা, এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য হলেন শাহ্-ই-বাঙালিয়ান, বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা শামস্উদ্দিন ইলিয়াস শাহ্। মুসলিম শাসকদের রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা ভাষার যে সাহিত্য চর্চা শুরু হয়, তার মাধ্যমে বাংলা ভাষা একটি পরিপূর্ণ ভাষা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার যোগ্যতা অর্জন করে।

বাংলা ভাষাকে কলুষিত করার চেষ্টা পরবর্তীতে যুগে যুগে আরো হয়। ১৮শ’ সালে ব্রিটিশরা কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা করে বাংলা ভাষার আরবী ও ফারসী শব্দ বাদ দিয়ে সংস্কৃত শব্দ প্রবেশের উদ্দেশ্যে সাহিত্য চর্চা শুরু করে। তারা দেখাতে চায়, “বাংলা ভাষার সাথে মুসলমানদের কোন সম্পর্ক নেই”।

উপনিবেশিক শাসকদের প্ররোচনায় মুসলিমদের হেয় প্রতিপন্ন করতে প্রচার করা হয়, বাংলা ভাষায় প্রথম কুরআন শরীফ অনুবাদ নাকি গিরিশ চন্দ্র সেন করেছে। অথচ ১৮৮৬ সালে গিরিশ চন্দ্র সেনের অনুবাদের বহু পূর্বে ১৮০৮ সালে বাংলা ভাষায় কুরআন শরীফের আংশিক অনুবাদ করেন মাওলানা আমীরুদ্দীন বসুনিয়া। এরপর ১৮৩৬ সনে মৌলভী নাঈমুদ্দীন পূর্ণাঙ্গ কুরআন মাজীদের বাংলা অনুবাদ সম্পন্ন করেন। অথচ এরা রয়ে গেছে অনেকটা লোকচক্ষুর আড়ালে। এটি নিঃসন্দেহে সত্যি শ্রীযুক্ত গিরিশ চন্দ্র সেন ছিলেন একজন প্রকাশক। ‌তার সহায়তায় কুরআন আল কারীমের বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়।

আজ বহুজাতিক ভাষা ইংরেজির আগ্রাসনের শিকার বাংলা ভাষা। আজও স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের বিচার বিভাগ মুক্ত হতে পারেনি ইংরেজির কবল থেকে। বিচার বিভাগ থেকে সকল রায় ও ফরমান জারি করা হয় ইংরেজি ভাষায়। যদিও বাংলাদেশের জনসাধারণ দীর্ঘ দিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছে বিচার বিভাগের বাংলা করনের জন্য। ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে ব্যবহার করা হচ্ছে ইংরেজি ভাষায় লেখা ফলক। এমনকি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ মঞ্জুরীপত্র লেখা হচ্ছে ইংরেজিতে। এটি অনভিপ্রেত। তাই নীতি নির্ধারণী মহলের নিকট জোর দাবি জানাচ্ছি বাংলা ভাষা রক্ষার্থে পশ্চিম বঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম ও রাখাইনে সকল ধরনের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের এবং বাংলাদেশে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার জন্য।

তথ্যসূত্রঃ
১। খন্দকার কামরুল হুদা, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও শেখ মুজিব।
২। বাংলাপিডিয়া

নিবন্ধ – মাহফুয রহমান
শিক্ষাকর্মী এবং ভূতপূর্ব ব্যাংক কর্মকর্তা।
মালয়েশিয়া নিউজ

Please Share This Post in Your Social Media
April 2024
T W T F S S M
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
30