২৭শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১৪ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৮ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

আজ বাংলাদেশের সংবিধান দিবস

অভিযোগ
প্রকাশিত নভেম্বর ৪, ২০১৯
আজ বাংলাদেশের সংবিধান দিবস

জান্নাতুল ফেরদৌস : সংবিধান প্রণয়নের ৪৮ বছর পর যদি আমরা সংবিধানের দিকে দৃষ্টিপাত করি, তাহলে দেখতে পাই, এর কতগুলো পরিপূর্ণভাবে অর্জিত হয়েছে, কতগুলো অর্জনের বিরামহীন প্রচেষ্টা চলছে এবং কতগুলোর অগ্রগতি সন্তোষজনক নয়

আজ ৪ নভেম্বর সংবিধান দিবস। আজ থেকে ৪৮ বছর আগে ১৯৭২ সালের এ দিনে রক্তপ্লাবিত সদ্যস্বাধীন আমাদের এ দেশে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন তথা ‘সংবিধান’ প্রণয়ন করা হয়েছিল। কালের পরিক্রমায় রাজনৈতিক অভিলাষে, প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে আজ সেই সংবিধানের শরীরে অজস্র কাটাছেঁড়ার দাগ। মাঝে সামরিক শাসনের জাঁতাকলে এ সংবিধান রহিতও করা হয়েছিল।

১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর তৎকালীন গণপরিষদে (বর্তমানের জাতীয় সংসদ) সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান গৃহীত হয়েছিল। স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র ১০ মাসের মাথায় সংবিধান প্রণয়ন ও অনুমোদন বিশ্বের ইতিহাসে একটি বিরল ঘটনা। ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস থেকে এ সংবিধান কার্যকর হয়। সংবিধান একটি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন। কোনো শাসনব্যবস্থার মূলগ্রন্থ সংবিধান, যাতে স্বায়ত্তশাসিত কোনো রাজনৈতিক সত্তার কর্তব্য নির্ধারণের মৌলিক নিয়ম ও সূত্রগুলো লিপিবদ্ধ থাকে। চার মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে বাহাত্তরের সংবিধান প্রণয়ন করা হয়েছিল। ১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর কোনো সরকারই তার চর্চা করেনি বলে মনে করেন আইনজ্ঞরা।

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করে সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে পা রাখেন।

এর পরদিন ১১ জানুয়ারি তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের জন্য অস্থায়ী সাংবিধানিক আদেশ জারি করেন। ২৩ মার্চ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশ গণপরিষদ আদেশ জারি করেন।

এ আদেশে ১৯৭০ ও ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিজয়ী জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যরা গণপরিষদের সদস্য হিসেবে বিবেচিত হন। এ গণপরিষদের সদস্য ছিলেন ৪৩০ জন।

১৯৭২ সালের ১১ এপ্রিল তৎকালীন আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেনকে (জাতীয় পরিষদ সদস্য, ঢাকা-৯) সভাপতি করে ৩৪ সদস্যের সংবিধান প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়। প্রণয়ন কমিটির একমাত্র মহিলা সদস্য ছিলেন বেগম রাজিয়া বানু (নারী আসন, জাতীয় পরিষদ)। কমিটিতে একমাত্র বিরোধীদলীয় সদস্য ছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত (প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য, সিলেট-২)।

কমিটির সদস্যরা ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ (জাতীয় পরিষদ সদস্য, ঢাকা-৫), সৈয়দ নজরুল ইসলাম (জাতীয় পরিষদ সদস্য, ময়মনসিংহ-১৭), এএইচএম কামারুজ্জামান (জাতীয় পরিষদ সদস্য, রাজশাহী-৬), এম আবদুুর রহিম (প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য, দিনাজপুর-৭), এম আমীর-উল ইসলাম (জাতীয় পরিষদ সদস্য, কুষ্টিয়া-১), ক্ষিতীশ চন্দ্র (জাতীয় পরিষদ সদস্য, বাকেরগঞ্জ-১৫), আবদুল মমিন তালুকদার (জাতীয় পরিষদ সদস্য, পাবনা-৩), মো. লুৎফর রহমান (জাতীয় পরিষদ সদস্য, রংপুর-৪), আবু সাইয়িদ (জাতীয় পরিষদ সদস্য, পাবনা-৫), মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম মনজুর (জাতীয় পরিষদ সদস্য, বাকেরগঞ্জ-৩), আবদুল মুনতাকীম চৌধুরী (জাতীয় পরিষদ সদস্য, সিলেট-৫), খন্দকার মোশতাক আহমেদ (জাতীয় পরিষদ সদস্য, কুমিল্লা-৮), আবদুুর রউফ (জাতীয় পরিষদ সদস্য, রংপুর-১১), মোহাম্মদ বায়তুল্লাহ (জাতীয় পরিষদ সদস্য, রাজশাহী-৩), বাদল রশীদ (বার অ্যাট ল’), খন্দকার আবদুল হাফিজ (জাতীয় পরিষদ সদস্য, যশোর-৭), শওকত আলী খান (জাতীয় পরিষদ সদস্য, টাঙ্গাইল-২), মো. হুমায়ুন খালিদ, আছাদুজ্জামান খান (প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য, যশোর-১০), একে মোশাররফ হোসেন আখন্দ (জাতীয় পরিষদ সদস্য, ময়মনসিংহ-৬), আবদুল মমিন, শামসুদ্দিন মোল্লা (জাতীয় পরিষদ সদস্য, ফরিদপুর-৪), শেখ আবদুর রহমান (জাতীয় পরিষদ সদস্য, খুলনা-২), ফকির সাহাব উদ্দিন আহমদ, অধ্যাপক খোরশেদ আলম (জাতীয় পরিষদ সদস্য, কুমিল্লা-৫), সিরাজুল হক (জাতীয় পরিষদ সদস্য, কুমিল্লা-৪), দেওয়ান আবু আব্বাছ (প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য, কুমিল্লা-৫), হাফেজ হাবিবুর রহমান (জাতীয় পরিষদ সদস্য, কুমিল্লা-১২), আবদুর রশিদ, নুরুল ইসলাম চৌধুরী (জাতীয় পরিষদ সদস্য, চট্টগ্রাম-৬) এবং মোহাম্মদ খালেদ (জাতীয় পরিষদ সদস্য, চট্টগ্রাম-৫)। ১৯৭২ সালের ১৭ এপ্রিল থেকে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত এ কমিটি বিভিন্ন পর্যায়ে বৈঠক করে। জনগণের মতামত সংগ্রহের জন্য মতামত আহ্বান করা হয়। সংগ্রহীত মতামত থেকে ৯৮টি সুপারিশ গ্রহণ করা হয়। ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর গণপরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশনে তৎকালীন আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন খসড়া সংবিধান বিল আকারে উত্থাপন করেন। তৎকালীন কয়েকজন নেতৃস্থানীয় ছাত্রনেতা সংবিধান প্রণয়নে গণপরিষদ সদস্যদের কর্তৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেন। ২০ অক্টোবর ছাত্রনেতা আ স ম আবদুর রব ও শাহজাহান সিরাজ একটি বিবৃতি দেন। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে বাংলাদেশের সংবিধান গৃহীত হয় এবং ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২ (মহান বিজয় দিবস) থেকে কার্যকর হয়।

আমাদের সংবিধানে এ পর্যন্ত ১৭টি সংশোধনী আনা হয়। প্রথম সংশোধনী আনা হয় ১৯৭৩ সালের ১২ জুলাই। সেদিন তৎকালীন আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন যুদ্ধাপরাধীসহ অন্য মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করা সংক্রান্ত সংবিধানের প্রথম সংশোধনী উত্থাপন করেন, যা ১৫ জুলাই সংসদে গৃহীত হয় এবং ১৭ জুলাই রাষ্ট্রপতি কর্তৃক অনুমোদিত হয়। এটি সংবিধান (প্রথম সংশোধনী) আইন, ১৯৭৩ নামে পরিচিত। এরপর পর্যাক্রমে মোট ১৭টি সংশোধনী আনা হয়েছে।

সংবিধানের সর্বশেষ সংশোধনী আনা হয় ২০১৮ সালের ১০ এপ্রিল। আরও ২৫ বছরের জন্য জাতীয় সংসদের ৫০টি আসন শুধু নারী সংসদের জন্য সংরক্ষিত রাখা বিষয়ে আনীত সংশোধনী প্রস্তাব ওই বছরের ৮ জুলাই সংসদে পাস হয়। এটিই আমাদের সংবিধানে এ যাবৎকালের গৃহীত সর্বশেষ সংশোধনী, যা সপ্তদশ সংশোধনী হিসেবে পরিগণিত।

আইনজ্ঞদের অভিমত সংবিধানের সংশোধনীগুলোর কতগুলো প্রশাসন, রাষ্ট্র পরিচালনা, প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্কসহ অন্যান্য বাস্তবতাজনিত কারণে প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। আবার কতকগুলো সংশোধনী রাষ্ট্র-জাতি-অর্থনীতি-উন্নয়ন কোনো কিছুর সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট নয়। এগুলো শুধু সে সময়কার রাষ্ট্রনায়কদের ব্যক্তিগত রুচি-অভিরুচি-অভিপ্রায়-অভিলাষের প্রতিফলন।

আমাদের সংবিধানের প্রথম তিনটি সংশোধনী পুরোপুরি প্রশাসনিক। তৃতীয় সংশোধনীর সুফল বেশ কিছুটা বিলম্বে হলেও বাংলাদেশ পেয়েছে।

আমরা আমাদের ছিটমহল ও অপদখলীয় জমি ফেরত পেয়েছি। চতুর্থ সংশোধনী নিয়ে অনেকে নানারকম মন্তব্য করেন। কিন্তু তৎকালীন উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এটি ছিল জাতির জনকের একটি সাহসী ও দূরদর্শী সিদ্ধান্ত। একদিকে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ, ভঙ্গুর যোগাযোগব্যবস্থা, বন্যা-অতিবৃষ্টি, খাদ্যদ্রব্যসহ সবকিছুর ঘাটতি, অবৈধ অস্ত্র, অন্যদিকে ব্যাপক চোরাচালানি, মজুতদারি, মূল্যবৃদ্ধি, বাজারে কারসাজি প্রভৃতি এরই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে একশ্রেণির বাম সন্ত্রাসীদের রাজনীতির নামে নির্মম-নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ। নকশাল বাহিনী, সিরাজ-শিকদার বাহিনী, হক গ্রুপ, মতিন গ্রুপ, তোহা গ্রুপসহ অনেকে শ্রেণি সংগ্রামের নামে সারা দেশে জনগণকে হত্যা, বাজার লুট, থানা লুটের মাধ্যমে দেশে এক অস্থিরতার সৃষ্টি করে।

এ রকম চরম উদ্বেগময় মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনা করে সীমিত সময়ের জন্য জাতির ঐতিহাসিক স্বার্থে বহুদলীয় রাজনীতির পরিবর্তে একদলীয় রাজনীতির প্রবর্তন করেন, যার নাম দেন বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ, যা সংক্ষেপে বাকশাল নামে পরিচিতি। সব রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবী সংগঠনকে বাকশালে আমন্ত্রণ জানানো হয়। বঙ্গবন্ধু এটিকে দ্বিতীয় বিপ্লব বলে ঘোষণা দেন।

১৫ আগস্ট ১৯৭৫-এর ঘটনা পরম্পরায় ১৯৭৯ সালে পঞ্চম সংশোধনী আনা হয়। এটি বাংলাদেশের জারিকৃত প্রথম সামরিক শাসনকে বৈধতা দেয়। সপ্তম সংশোধনীও সামরিক শাসনকে বৈধতা দেয়।

অষ্টম সংশোধনীর তিনটি ভাগÑ প্রথমে বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলাম ধর্মকে স্বীকৃতি দান। এটি একটি রাজনৈতিক স্ট্যান্ট ছাড়া আর কিছুই নয়।

সেনানিবাস ছেড়ে লে. জে. এরশাদের শখ হয়েছিল রাজনৈতিক দল গঠন করা। তিনি জাতীয় পার্টি নামে রাজনৈতিক দল গঠন করলেন। এ দেশের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ ধর্মপ্রাণ মুসলমান। বিশাল এ জনগোষ্ঠীর হৃদয় জয় করার জন্য তিনি সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করলেন। অষ্টম সংশোধনীর দ্বিতীয় অংশ ছিল ঢাকার বাইরে ছয়টি জেলায় হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ স্থাপন। যদিও পরবর্তী সময়ে ঢাকার আইনজীবীদের প্রবল বিরোধিতায় তা বাতিল ঘোষিত হয়।

সংবিধান প্রণয়নের ৪৮ বছর পর যদি আমরা সংবিধানের দিকে দৃষ্টিপাত করি, তাহলে দেখতে পাই, এর কতকগুলো পরিপূর্ণভাবে অর্জিত হয়েছে, কতকগুলো অর্জনের বিরামহীন প্রচেষ্টা চলছে এবং কতকগুলোর অগ্রগতি সন্তোষজনক নয়।

জান্নাতুল ফেরদৌস
গণমাধ্যমকর্মী ও কলামিস্ট

Please Share This Post in Your Social Media
April 2024
T W T F S S M
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
30