৭ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৪শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৮শে শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

কে এই আজিজ মোহাম্মদ ভাই!

অভিযোগ
প্রকাশিত অক্টোবর ২৭, ২০১৯
কে এই আজিজ মোহাম্মদ ভাই!

মনজুরুল ইসলাম :: রাজধানীর গুলশানে আজিজ মোহাম্মদ ভাই’র বাসায় অভিযান চালিয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। রোববার (২৭ অক্টোবর) বিকেল সাড়ে চারটা থেকে এই অভিযান শুরু হয়। অভিযানে আজিজ মোহাম্মদ ভাই’র গুলশান-২-এর ৫৭ নম্বর রোডের ১১/এ বাসা থেকে সিসা ও বিদেশি মদ জব্দ করা হয়েছে বলে গণমাধ্যমকে জানান মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক খুরশিদ আলম।

আজিজ মোহাম্মদ ভাই একজন ব্যবসায়ী ও চলচ্চিত্র প্রযোজক। জনপ্রিয় নায়ক সালমান শাহকে হত্যার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, তার বিরুদ্ধে হত্যা ও মাদক পাচারসহ বেশ কয়েকটি গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। ৫০টির মত চলচ্চিত্র প্রযোজনা করেছেন তিনি। ১৯৪৭ এ দেশভাগের পর তাদের পরিবার ভারতের গুজরাট থেকে বাংলাদেশে আসে। তাদের পরিবার মূলত পারস্য বংশোদ্ভুত। তারা ‘বাহাইয়ান’ সম্প্রদায়ের লোক। ‘বাহাইয়ান’ কে সংক্ষেপে ‘বাহাই’বলা হয়। উপমহাদেশের উচ্চারণে এই ‘বাহাই’ পরবর্তীতে ‘ভাই’হয়ে যায়।

বর্তমানে আজিজ মোহাম্মদ ভাই সপরিবারে থাইল্যান্ডে থাকেন। সেখান থেকেই ব্যবসা পরিচালনা করেন। তার স্ত্রী নওরিন মোহাম্মদ ভাই দেশে এসে ব্যবসা দেখেন। তার ৩ ছেলে ও ২ মেয়ে রয়েছে।

জানা যায়, অজিজ মোহাম্মদ নামের সাথে ‘ভাই’ শব্দটি নিয়ে অনেকেই মনে করেন গডফাদার বলেই তাকে ভাই বলে ডাকা হয়। সাধারণত মাফিয়া ডন বা গডফাদার দের ভাই ডাকে তাদের অনুগতরা। কিন্তু আজিজ মোহাম্মদ ভাই, ইনাকে গডফাদার বলা যায় কিনা সেটা নিয়ে তর্ক থাকলেও ভাই শব্দটি সে কারণে আসে নি। ‘ভাই’ তাদের বংশপদবী। তাঁদের পরিবারের সকলেরই নামের শেষে ভাই পদবী আছে।

পারিবারিকসূত্রে আজিজ মোহাম্মদ বেশ ধনাঢ্য ব্যাক্তি। অলিম্পিক ব্যাটারী, অলিম্পিক বলপেন, এমবি ফার্মাসিটিউক্যাল, এমবি ফিল্ম, টিপ বিস্কুট, এনার্জি বিস্কুট ইত্যাদি তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এছাড়া মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, হংকং, সিঙ্গাপুরে তার হোটেল রিসোর্টের ব্যবসা আছে।

তিনি নব্বই দশকে অর্থলগ্নি করেন সিনেমাতে। ৫০টির বেশি সিনেমাতে তিনি বিনিয়োগ করেন। যেহেতু সিনেমায় লগ্নি করেন তাই এই সূত্রে আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সাথে সালমানের পরিবারের সখ্যতা গড়ে উঠে। একটি পার্টিতে সালমান সস্ত্রীক উপস্থিত ছিলেন। সেই পার্টির এক পর্যায়ে সালমানের স্ত্রী সামিরাকে চুমু খেতে নিলে সালমান ক্ষিপ্ত হয়ে আজিজ মোহাম্মদ ভাইকে চড় মেরে বসেন।

তার এক সপ্তাহ পর রহস্যজনক মৃত্যু হয় সালমান শাহ’র। প্রাথমিকভাবে আত্মহত্যা বলা হলেও গুঞ্জন উঠে এটি একটি হত্যাকান্ড। তখনই চড় দেয়ার ব্যাপারটি আলোচিত হয়। ধারণা করা হয়, আজিজ মোহাম্মদ ভাই হয়ত সালমানের মৃত্যুর সাথে কোনোভাবে জড়িত।

সালমানের বাবা কমরউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী ১৯৯৭ সালের ১৯ জুলাই রিজভি আহমেদ নামের এক যুবকের বিরুদ্ধে বাসায় অনধিকার প্রবেশের অভিযোগ এনে ক্যান্টনমেন্ট থানায় একটি মামলা করেন। মামলার আসামি রিজভী ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে জানিয়েছিলেন এক চাঞ্চল্যকর তথ্য। সালমান শাহ হত্যার জন্য পরিকল্পনার চুক্তিটি হয় ১২ লাখ টাকার। চুক্তিটি করেন সালমানের স্ত্রী সামিরার মা লাতিফা হক।

রিজভী জবানবন্দিতে বলেছিলেন, সালমানকে হত্যা করতে সামিরার মা লাতিফা হক, ডন, ডেভিড, ফারুক, জাভেদের সঙ্গে ১২ লাখ টাকার চুক্তি করেন। চুক্তিতে উল্লেখ ছিল, সালমানকে শেষ করতে কাজের আগে ৬ লাখ ও কাজের পরে ৬ লাখ দেয়া হবে।

জবানবন্দিতে খুনের বর্ণনাও দেন রিজভী। তার বর্ণনামতে, সালমানকে ঘুমাতে দেখে তার ওপর ঝাপিয়ে পড়া হয় তার উপর। ফারুক পকেট থেকে ক্লোরোফর্মের শিশি বের করে। সালমানের স্ত্রী সামিরা তা রুমালে দিয়ে সালমানের নাকে চেপে ধরে। ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে মামলার তিন নম্বর আসামি আজিজ মোহাম্মদ এসে সালমানের পা বাঁধে এবং খালি ইনজেকশন পুশ করে। এতে সামিরার মা ও সামিরা সহায়তা করে। পরে ড্রেসিংরুমে থাকা মই এনে প্লাস্টিকের দড়ি দিয়ে আজিজ মোহাম্মদ ভাই সিলিং ফ্যানে সালমানকে ঝুলিয়ে দেয়।

কিন্তু, পরে তদন্ত গাফিলতি হোক কিংবা প্রমাণের অভাব হোক আসামিরা ছাড়া পায়। পুলিশের কাছে এই জবানবন্দিটি সাজানো মনে হয়। এই মৃত্যু নিয়ে তৈরি হয় ধোঁয়াশা। যদিও সালমানের বাসা থেকে চেতনানাশক রাসায়নিক জব্দ করা হয়, কিন্তু তদন্তে প্রতিবেদনে তার উল্লেখ পাওয়া যায়না। আরেক চিত্রনায়ক অকালপ্রয়াত সোহেল চৌধুরী হত্যাতেও তার নাম জড়িত।

১৯৯৮ সালের ডিসেম্বরের এক রাতে বনানীর ট্রাম্পস ক্লাবে চলছে ডিজে পার্টি। ঘটনার দিন রাত ৯টায় সোহেল চৌধুরী বনানীর বাসা থেকে বের হন ক্লাবে যাওয়ার উদ্দেশ্যে।

এ সময় সোহেলের সাথে চারজন বন্ধু ছিলেন। রাত দুইটার দিকে তারা ক্লাবে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হন। সোহেলের বাড়ি থেকে ২৫-৩০ গজ দূর। ক্লাবের নিচ তলার কলাপসিবল গেটের কাছে দুই যুবক তাদের গতিরোধ করে। তাদের একজন সোহেলের বন্ধু আবুল কালামের সঙ্গে তর্ক করতে থাকেন। এই সুযোগে অন্য যুবক রিভলবার বের করে কালামের পেটে দুটি গুলি করে। তারপরই গুলি করা হয় সোহেল চৌধুরীকে। হাসপাতালে নেয়ার পর জানা যায় মাত্র ৩৫ বছর বয়স্ক এই নায়ক আর নেই।

ঘটনার দিনই সোহেলের ভাই তৌহিদুল ইসলাম চৌধুরী গুলশান থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলায় অভিযোগে বলা হয়, হত্যাকাণ্ডের কয়েক মাস আগে কথিত এক বান্ধবীকে নিয়ে ওই ক্লাবের মধ্যে সোহেল চৌধুরীর সঙ্গে আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের তর্কাতর্কি হয়। তখন উত্তেজিত হয়ে সোহেল ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাইকে গালাগালি করেন। তার প্রতিশোধ হিসেবে সোহেলকে হত্যা করা হয়।

১৯৯৯ সালের ৩০ জুলাই ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী পুলিশ কমিশনার আবুল কাশেম ব্যাপারী ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাইসহ নয়জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেন। অন্য আসামিরা হলেন- ট্রাম্পস ক্লাবের মালিক আফাকুল ইসলাম ওরফে বান্টি ইসলাম ও আশীষ চৌধুরী, শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমন, আদনান সিদ্দিকী, তারিক সাঈদ মামুন, সেলিম খান, হারুন অর রশীদ ওরফে লেদার লিটন ও ফারুক আব্বাসী।

সোহেল চৌধুরী হত্যাকাণ্ডে আলোচিত ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাইকে গোয়েন্দা পুলিশ গ্রেপ্তারও করে। এই হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্তদের বেশিরভাগই আন্ডারওয়ার্ল্ডের দুর্ধর্ষ সব সন্ত্রাসীর। একটি খুনের ঘটনায় একসঙ্গে বেশ কয়েকজন শীর্ষ সন্ত্রাসীর অংশ নেওয়া ছিল বিরল ঘটনা। যদিও সোহেল হত্যা মামলা হাইকোর্টের আদেশে স্থগিত হয়ে যায়।

এরশাদের প্রেমিকা মেরির প্রতি আজিজের আকৃষ্ট ছিলেন, ফলে এরশাদ তাকে জেলে নিয়েছিলেন এমন মুখরোচক গল্পও প্রচলিত আছে তার নামে। প্রচার আছে, মিডিয়ার অনেক তরুণীর সাথে তার অন্তরঙ্গ সম্পর্কের গল্প। তবে আজিজ মোহাম্মদ নিজে মিডিয়ার আলোচনা এবং তাকে ঘিরে মিথ পছন্দ করতেন। প্রায়ই বলতেন, এতো লোকের মাঝে আমাকেই গডফাদার বলা হয়, তাই বা কম কিসে!

Please Share This Post in Your Social Media
May 2024
T W T F S S M
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
28293031