৬ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৩শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৭শে শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

জাল সনদে নয় বছরে তেইশ লক্ষাধিক টাকা আত্মসাৎ

অভিযোগ
প্রকাশিত সেপ্টেম্বর ২৬, ২০১৯
জাল সনদে নয় বছরে তেইশ লক্ষাধিক টাকা আত্মসাৎ

অভিযোগ ডেস্ক ::  পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার সরকারি হাজী জামাল উদ্দিন ডিগ্রি কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান নাজনীন নাহারের নিবন্ধন সনদ এনটিআরসি এর যাচাই-বাছাইয়ে জাল ধরা পড়েছে। এ বিষয়ে এনটিআরসিএ ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট থানায় মামলা করতে কলেজ কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন।

তবে ওই শিক্ষকের স্বামী উপজেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক আবদুল হাই বাচ্চু রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে কলেজ কর্তৃপক্ষকে ওই জাল সনদধারী শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাধা দিচ্ছেন। এতে কলেজ কর্তৃপক্ষ নাজনীন নাহারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তবে কলেজ কর্তৃপক্ষের দাবি এনটিআরসিএর যাচাই-বাছাইয়ে জাল সনদ ধরা পড়ার পর ওই শিক্ষক নিজেই চাকরি থেকে অব্যাহতি নেওয়ায় কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

সূত্র জানায়, ২০১০ সালে নাজনীন নাহার সরকারি হাজী জামাল উদ্দিন ডিগ্রী কলেজে প্রভাষক পদে আবেদন করে চূড়ান্ত নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। সে সময় নাজনীনের নিবন্ধন সনদ জাল সন্দেহে নিয়োগ বোর্ড তাকে পরীক্ষা থেকে বাহির করে দিতে চায়। কিন্তু ওই শিক্ষকের স্বামী উপজেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক আবদুল হাই বাচ্চু কলেজের গভর্নিং বডি ও নিয়োগ বোর্ডকে ম্যানেজ করে তার স্ত্রীকে নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার ব্যবস্থা করেন। পরে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা শেষে চূড়ান্তভাবে জাল নিবন্ধন সনদধারী নাজনীন নাহারকে নিয়োগ দেওয়া হয়।

এ নিয়ে কলেজের অন্যান্য শিক্ষকদের মধ্যে ওই শিক্ষককে নিয়ে তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি হয়। তবে নিয়োগ বোর্ড তার নিবন্ধন সনদ যাচাইয়ের জন্য তখন কলেজ কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন।

কিন্তু কলেজ কর্তৃপক্ষ পরবর্তীতে আর সনদ যাচাই করেনি।

সূত্র আরো জানায়, নিয়োগের পরে এমপিওভুক্তির সময় মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের এমপিও শাখায় ওই শিক্ষকের নিবন্ধন সনদ জাল ধরা পড়ে।

তখন লক্ষাধিক টাকা খরচ করে সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তা ও কর্মচারীদেরকে ম্যানেজ করে এমপিওভুক্ত হন ওই শিক্ষক। এমনকি এরপর একাধিকবার ওই কলেজে সরকারি অডিট হলেও মোটা অংকের টাকা খরচ করে ওই জাল নিবন্ধনধারী শিক্ষক ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যান।

এভাবে গত ৯ বছর ধরে ওই শিক্ষক জাল নিবন্ধন সনদ দিয়েই বহাল তবিয়তে চাকরি করে হাতিয়ে নিয়েছেন সরকারের ২৩ লক্ষাধিক টাকা।

খোঁজ-খবর নিয়ে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুসারে ২০১৬ সালে এই কলেজকে জাতীয়করণের প্রক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

তখন থেকে সরকারিভাবে শিক্ষকদের সনদসহ কলেজের সকল নথিপত্র যাচাই-বাছাইয়ের কাজ শুরু হয়। এই প্রক্রিয়ার এক পর্যায়ে গত বছরের ১২ আগস্ট এই কলেজের সরকারিকরণের জিও (গভর্ণমেন্ট অর্ডার) জারি হয়।

এরপর এনটিআরসিএ প্রথম থেকে পঞ্চম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের নিবন্ধন সনদ যাচাই-এর জন্য তলব করেন কলেজ কর্তৃপক্ষকে। তখন কলেজ কর্তৃপক্ষ নিয়োগপ্রাপ্ত ১৭ জন শিক্ষকের নিবন্ধন সনদ এনটিআরসি-এর কাছে প্রেরণ করেন। যাচাই-বাছাই শেষে চলতি মাসের ৫ সেপ্টেম্বর এনটিআরসিএ নাজনীন নাহারের নিবন্ধন সনদ জাল বলে প্রতিবেদন কলেজে পাঠান। একই সঙ্গে ওই প্রতিবেদনের অনুলিপি কপি ভাঙ্গুড়া থানায় পাঠিয়ে কলেজ কর্তৃপক্ষকে নাজনীন নাহারের বিরুদ্ধে মামলা করতে নির্দেশ দেন। এরপর কলেজের অধ্যক্ষ শহীদুজ্জামান সনদটি অধিকতর যাচাইয়ের জন্য গত সপ্তাহে ঢাকার বিভিন্ন অফিসে খোঁজ-খবর নিয়ে জাল সনদের বিষয়ে নিশ্চিত হন। কিন্তু এনটিআরসি-এর নির্দেশের ২০ দিন পার হলেও কলেজ কর্তৃপক্ষ ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে কোনো প্রকার আইনগত ব্যবস্থা নেননি। কলেজ কর্তৃপক্ষের দাবি, নিবন্ধন সনদ জল ধরা পড়ার পর ওই শিক্ষক নাজনীন নাহার নিজেই চাকরি থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন।

এছাড়া ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেই সে হাইকোর্টে কলেজের বিরুদ্ধে মামলা করবে। এতে কলেজের সরকারিকরণের প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হতে পারে। তাই আপাতত তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। উল্লেখ্য, ওই শিক্ষকের স্বামী আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল হাই বাচ্চুর বিরুদ্ধেও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে পার্শ্ববর্তী চাটমোহর উপজেলার মির্জাপুর ডিগ্রী কলেজের অধ্যক্ষের পদে নিয়োগ নেওয়ার অভিযোগ আছে। ওই ঘটনায় তার নিয়োগের বিরুদ্ধে আদালতে মামলাও চলছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাজী জামাল উদ্দিন ডিগ্রী কলেজের একজন শিক্ষক বলেন, ‘নিয়োগের পরই আমরা শুনেছিলাম ওই শিক্ষকের নিবন্ধন সনদ জাল। কিন্তু কলেজ কর্তৃপক্ষ ও নিয়োগ বোর্ড তাকে নিয়োগ দেওয়ায় কেউই কিছু বলতে পারেনি। এছাড়া ওই শিক্ষকের স্বামী আওয়ামী লীগ নেতা বাচ্চু বিভিন্ন অপকর্ম করে টিকে থাকায় সবাই তাকে ভয়ও পায়।

অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে জাল সনদধারী নাজনীন নাহারকে একাধিকবার মোবাইল ফোনে কল করলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

এ বিষয়ে ভাঙ্গুড়া হাজী জামাল উদ্দিন ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ শহীদুজ্জামান বলেন, এনটিআরসিএ কর্তৃক নাজনীন নাহারের নিবন্ধন সনদ জাল বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পরই তাকে নোটিশ করা হয়। কিন্তু ওই শিক্ষক আর পরবর্তীতে কলেজে না এসে নিজে থেকে অব্যাহতি দেয়।

কিন্তু জাল সনদের বিষয়ে এনটিআরসি-এর নির্দেশক্রমে থানায় মামলা দায়েরের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, যেহেতু নিজেই ওই শিক্ষক চাকরি থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন। তাই আপাতত তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত কলেজ কর্তৃপক্ষের নেই।

ভাঙ্গুড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও কলেজের সভাপতি সৈয়দ আশরাফুজ্জামান বলেন, যেহেতু জাল সনদ দিয়ে চাকরি নিয়ে নয় বছর ধরে সরকারি বেতন ভোগ করেছেন। তাই সরকারি টাকা ফেরত দিতে জাল নিবন্ধনধারী শিক্ষকের বিরুদ্ধে কলেজ কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে হবে। এক্ষেত্রে বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

Please Share This Post in Your Social Media
May 2024
T W T F S S M
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
28293031