৫ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২২শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৬শে শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

শেরপুরের একজন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নুরুল ইসলাম হিরো

প্রকাশিত অক্টোবর ১৪, ২০২০
শেরপুরের একজন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নুরুল ইসলাম হিরো

 

মোঃতারিফুল আলম (তমাল)
শেরপুর জেলা প্রতিনিধি

সনদসর্বস্ব নামমাত্র মুক্তিযোদ্ধা তিনি নন, মুক্তিযুদ্ধ থেকে উৎসারিত চেতনার ফল্গুধারা তার রন্ধ্রে-রন্ধ্রে প্রবহমাণ। তার যুদ্ধ একাত্তরেই সীমাবদ্ধ ছিল না, তিনি যুদ্ধ করে চলছেন এখনও। তিনি কেবল পাকিস্তান সেনাবাহিনী বা তাদের এ-দেশীয় জামায়াতি দোসরদের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করেননি, তাকে লড়তে হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেয়েও বড় আরেকটি যুদ্ধে। সেই যুদ্ধটি তার নিজ পরিবারের বিরুদ্ধে, বাবার বিরুদ্ধে, মায়ের বিরুদ্ধে, বোনের বিরুদ্ধে, বোনের স্বামীর বিরুদ্ধে। সশস্ত্র বহিঃশত্রুর বিরুদ্ধে ৯ মাস যুদ্ধ করার চেয়ে ৪৫ বছর ধরে নিজের নিরস্ত্র পরিবারের বিরুদ্ধ যুদ্ধ করা নিঃসন্দেহে কঠিন।

নুরুল ইসলাম হিরোর ছোটবোন নুরুন নাহারের বিয়ে হয় ১৯৭৯ সালে, শেরপুরের আল-বদর কমান্ডার কামারুজ্জামানের সাথে। কর্মক্ষেত্র থেকে বাড়িতে এসে হিরো যখন জানতে পান বাবা -মা একজন রাজাকারের সাথে নুরুন নাহারের বিয়ে ঠিক করেছেন, তখন তিনি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন ঐ বিয়ে ভাঙার জন্য। বিয়ে ভাঙতে ব্যর্থ হয়ে তার মাকে তিনি বলেছিলেন, ‘তুমি ভুল করছ, মা, আওয়ামী লীগ একদিন ক্ষমতায় আসবে। তখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে, তোমার মেয়ে তখন বিধবা হবে, মনে রেখো।’মাকে এ-কথা বলে ব্যর্থ-বিধ্বস্ত হতাশ-হতোদ্যম হিরো তৎক্ষণাৎ বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন এবং পরিবারের সাথে সম্পর্ক প্রায় ছিন্ন করেছিলেন। যে রাজাকারদের বিরুদ্ধে মাত্র আট বছর আগে তিনি অস্ত্র ধরেছিলেন, আট বছর পর সেই রাজাকারদেরই এক কমান্ডারের সাথে আপন বোনের বিয়েকে তিনি গণ্য করেছিলেন জীবনের বৃহত্তম পরাজয় হিশেবে। বোনের সাথে সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন হিরো।

কামারুজ্জামান শেরপুরে যতবার সংসদ-নির্বাচন করেছিল, হিরু ততবার তার বিরোধিতা করেছিলেন এবং পাঁচটি নির্বাচনের একটিতেও জিততে পারেনি জামায়াত-নেতা কামারুজ্জামান। হিরো চাকুরী করতেন অগ্রণী ব্যাংকে । প্রতিটি নির্বাচনের সময় তিনি ছুটি নিয়ে এসে বন্ধু বান্ধবদের এবং তার অনুসারীদেরকে ঐক্যবদ্ধ করে নিজেদের ব্যয়ে আওয়ামী লীগ এর প্রার্থীর পক্ষে দিবারাত্রি প্রচারণা করতেন। তার কাজে শতভাগ সততা, স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা আজকের যুগে তুলনাহীন। জীবনে অন্যায়ের সাথে কখনও আপোষ করেননি। নীতি ও আদর্শ থেকে কখনও তিনি পিছলে পড়েননি। বংগবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা বাস্তবায়নে তিনি জীবন বাজী রেখে কাজ করে যাচ্ছেন। অর্থ, সম্পদের প্রতি তার কোন মোহ নেই। বোনের বিয়ের ৩৬ বছর পরও পরিবারের সাথে আপস করেননি হিরো। আপন ভগ্নীপতি কামারুজ্জামানের ফাঁসির দাবিতে হিরো আন্দোলন করে গেছেন এবং ২০১৪ সালের বিজয় দিবসের মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশে ঘোষণা দেন যে কামারুজ্জামানের ফাসি কার্যকরের পর শেরপুরের মাটিতে তার লাশ কবর দিতে দেয়া হবেনা। সেই দাবীতে তার নেতৃত্বে বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ আন্দোলন চালিয়ে যান এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট স্মারকলিপি পেশ করেন। ২০১৫ এর ১১ এপ্রিল ফাসি কার্যকর হচ্ছে জেনে তিনি ঢাকা থেকে শেরপুরে আসার সকল সড়ক অবরোধ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। শেরপুরের জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা তাকে নকলা থেকে অনুনয় বিনয় করে ডেকে নিয়ে এসে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ও সেক্টর কমান্ডার ফোরামের নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনায় বসে অবরোধ তুলে নেয়ার জন্য অনুরোধ জানান। সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অনুরোধে সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে শেষ পর্যন্ত অবরোধ তুলে নেন। তবে তিনি এখনও মনে করেন, এলাকায় যুদ্ধপরাধীদের। কবরের সিদ্ধান্ত মোটেই সঠিক হয়নি। বাংলাদেশে নিজের একমাত্র বোনের স্বামীর ফাসির রায় দ্রততার সাথে দেয়া, ফাসি কার্যকরের পর এলাকায় কবর না দেয়ার ঘোষণা তিনিই একমাত্র দিয়েছেন, যা একটি বিরল ঘটনা। একজন সত্যিকারের প্রকৃত দেশপ্রেমীক।

Please Share This Post in Your Social Media
May 2024
T W T F S S M
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
28293031