২৮শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৯শে শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

হলি আর্টিজান হামলা মামলার রায় বুধবার

অভিযোগ
প্রকাশিত নভেম্বর ২৬, ২০১৯
হলি আর্টিজান হামলা মামলার রায় বুধবার

গুলশানে প্রায় ১২ ঘণ্টার রক্তাক্ত জিম্মি সংকটের অবসান ঘটে সকালে এক কমান্ডো অভিযানের মাধ্যমে – ফাইল ছবি

অভিযোগ ডেস্ক : রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা মামলার রায় ঘোষণার জন্য আগামীকাল ২৭ নভেম্বর বুধবার দিন ধার্য আছে। ২০১৬ সালের ১ জুলাইয়ের ওই ঘটনার প্রায় সোয়া তিন বছর পর নৃশংসতম ওই ঘটনার মামলার রায় হতে যাচ্ছে।

 

ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মজিবুর রহমান রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে রায়ের দিন ধার্য করে গত ১৭ নভেম্বর আদেশ দেন। সেদিন আদালত থেকে বের হওয়ার পর এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি গোলাম সারওয়ার খান জাকি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামি পক্ষের চার দিনব্যাপী যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হলে বিচারক আজ মামলার রায়ের জন্য ২৭ নভেম্বর তারিখ ধার্য করে দেন।’ সন্ত্রাসবিরোধী আইনের এই মামলায় ৮ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে পেরেছেন বলে দাবি করেন তিনি।

 

২০০৯ সালের এই আইনে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে হত্যার অপরাধ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।

২০১৮ সালের ২৬ নভেম্বর এই ৮ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের পর ৩ ডিসেম্বর মামলার বাদী এসআই রিপন কুমার দাসের জবানবন্দি নেয়ার মধ্য দিয়ে এই মামলার বিচার শুরু হয়েছিল।

 

এর আগে দুই বছরের বেশি সময় ধরে তদন্তের পর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের পরিদর্শক হুমায়ুন কবির ওই বছরের ২৩ জুলাই হামলায় জড়িত ২১ জনকে চিহ্নিত করে তাদের মধ্যে জীবিত ৮ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেন।

 

২০১৬ সালের ১ জুলাই হলি আর্টিজান বেকারিতে সংঘটিন ভয়াবহ ওই হামলায় হামলাকারীরা ১৭ বিদেশিসহ ২০ জনকে গলাকেটে হত্যা করে। হামলা ঠেকাতে গিয়ে নিহত হন দুই পুলিশ কর্মকর্তা। পরে কমান্ডো অভিযানে হামলাকারী হিসেবে চিহ্নিত পাঁচ তরুণের সবাই মারা যায়। তারা হলো- রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, মীর সামেহ মোবাশ্বের, নিবরাজ ইসলাম, শফিকুল ইসলাম ওরফে উজ্জ্বল ও খায়রুল ইসলাম ওরফে পায়েল।

নব্য জেএমবি রাজধানীর কূটনৈতিক এলাকায় হামলা চালিয়ে নিজেদের সামর্থ্যের জানান দেয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশে শরিয়া আইন প্রতিষ্ঠা করতে এই হামলার ছক কষেছিল বলে পুলিশের তদন্তে উঠে আসে। নজিরবিহীন ওই হামলা বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের বিপজ্জনক বিস্তারের মাত্রা স্পষ্ট করে তোলে। হামলার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধারাবাহিক অভিযানে দলটির শীর্ষনেতাদের বেশ কয়েকজন মারা যায়।

 

এই হামলায় জড়িত হিসেবে যে ৮ জনকে জীবিত গ্রেফতার করা হয়, তাদের বিচারের মুখোমুখি করা হয় হামলার পর এসআই রিপন কুমার দাসের করা সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলাটিতে। আসামিরা হলেন- জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী, রাকিবুল হাসান রিগান, আসলাম হোসেন ওরফে রাশেদুল ইসলাম ওরফে র‌্যাশ, সোহেল মাহফুজ, মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান, হাদিসুর রহমান সাগর, শরিফুল ইসলাম ও মামুনুর রশিদ।

 

মামলাটি তদন্ত করেন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের পরিদর্শক হুমায়ুন কবির। রাষ্ট্রপক্ষে ২১১ জন সাক্ষীর মধ্যে যে ১১৩ জনের সাক্ষ্য নেয়া হয়, তার মধ্যে সর্বশেষ জন ছিলেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।

সাক্ষ্যে হুমায়ুন কবির বলেছিলেন, হলি আর্টিজানে হামলার আগে জঙ্গিরা বাংলাদেশে বড় ধরনের হামলার পরিকল্পনা করে। এর অংশ হিসেবে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে গাইবান্ধার বোনারপাড়া বাজার এলাকার কলেজ মোড়ে একটি বাসায় মিটিং করে প্রথমে তারা হলি আর্টিজানে হামলার পরিকল্পনা করে। হলি আর্টিজান বেকারি কূটনৈতিক এলাকায় অবস্থিত থাকায় সেখানে হামলা করার পেছনে কারণ ছিল জঙ্গিদের নিজেদের সামর্থ্যের জানান দেয়া। এছাড়া বিদেশি নাগরিকদের হত্যা করে নৃশংসতার প্রকাশ ঘটনানোর পাশাপাশি তারা এর মাধ্যমে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে প্রচার করে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে চেয়েছিল।

 

তিনি বলেন, এই হামলার সঙ্গে জড়িত ২১ জনকে আমি শনাক্ত করি। এর মধ্যে ১৩ জন জঙ্গি পুলিশের বিভিন্ন জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নিহত হয়। বাকি ৮ জনকে এই মামলায় আসামি করা হয়েছে।

 

মামলার অভিযোগপত্রে তিনি বলেন, নব্য জেএমবির জঙ্গিরা ছয় মাস ধরে পরিকল্পনা করে ওই হামলা চালিয়েছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, দেশকে ‘অস্থিতিশীল করা’ এবং বাংলাদেশকে একটি ‘জঙ্গি রাষ্ট্র’ বানানো।

 

ফিরে দেখা : হলি আর্টিজান হামলা

সেদিন ছিল শুক্রবার। রমজান মাসের শেষ দিক। সামনে ঈদুল ফিতর। শেষ সময়ের কেনা-কাটায় ব্যস্ত মানুষ। ঈদের ছুটিও বেশ লম্বা। ৯ দিনের ছুটিতে কেউ নাড়ির টানে যাবেন গ্রামের বাড়িতে, কেউ যাবেন দেশের দর্শনীয় স্থানে বেড়াতে, আবার কেউ যাবেন বিদেশে। সাধারণ মানুষের সাধারণ আলোচনায় প্রধান্য পাচ্ছিল এসব বিষয়ই।

 

২০১৬ সালের ১ জুলাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম জুড়ে আলোচনাও ছিল তাই। তবে হঠাৎ করেই এসব ছাপিয়ে রাজধানীতে গুলশান-২ এলাকায় জঙ্গি হামলার খবর আসতে শুরু করে। সত্যাসত্য জানতে মানুষ টেলিভিশন ও অনলাইন নিউজ পোর্টালে চোখ রাখে।

 

শুরুতে খবর আসে সন্ত্রাসীদের সঙ্গে পুলিশের গোলাগুলি হচ্ছে গুলশানে। এক রেস্টুরেন্টে সশস্ত্র হামলাকারী ঢুকে বেশ কয়েকজনকে জিম্মি করেছে। ঘটনাটা আসলে কী, গুজব না আসলেই সত্য এবং ভয়ানক কিছু তা নিশ্চিত হতেও ঘণ্টাখানেক সময় চলে যায়।

পরে জানা যায়, হামলাকারীরা ওই রেস্টুরেন্টে থাকা বিদেশি নাগরিকসহ বেশ কয়েকজনকে জিম্মি করেছে।

 

জিম্মি সংকটের ঘটনায় ১ জুলাই রাতে সারা পৃথিবীর নজর ছিল ঢাকার অভিজাত গুলশান এলাকায় অবস্থিত হলি আর্টিজান বেকারির দিকে।

 

গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে ২০ জনকে হত্যা করা হয়। তাদের মধ্যে ৯ জন ইতালির, ৭ জন জাপানের, ৩ জন বাংলাদেশের এবং ১ জন ভারতের নাগরিক। সন্ত্রাসীদের হামলায় দুজন পুলিশও প্রাণ হারান। গুলশান হামলায় নিহতদের স্মরণে দুদিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালন করে বাংলাদেশ।

 

কী ঘটেছিল ওই রাতে?
রাত ৮টা ৪৫ মিনিট : গুলশান ৭৯ নম্বর সড়কের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গিরা হামলা চালায় বলে জানা যায়।

 

গুলশানের একজন বাসিন্দা রাশিলা রহিম গোলাগুলির ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দেন গণমাধ্যমকে।

 

তিনি বলেন, আমাকে আমার ড্রাইভার বললেন, ‘আপা আপনি এখন বেরুবেন না, নিচে গোলাগুলি চলছে। তারপর দেখি আমার ড্রয়িং রুমের জানালার কাঁচ ফেটে গেল। তারপর থেকে অনবরত গুলির শব্দ শুনতে পাই। এরপর আমার মেয়ে কান্নাকাটি শুরু করে। আমরা সবাই কান্নাকাটি শুরু করি। কারণ খুবই আতঙ্কজনক একটা পরিস্থিতি।’

 

রাত ৯টা ৫ মিনিট : জঙ্গি হামলার খবর পায় পুলিশ। গুলশানের পুলিশের এসিস্ট্যান্ট কমিশনার আশরাফুল করিম জানান, খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গুলশান থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে ছুটে যায়।

 

রাত ৯টা ২০ মিনিট : ঘটনাস্থলে গোলাগুলির শব্দ শুনতে পান প্রত্যক্ষদর্শীরা। ঢাকার উত্তরের তৎকালীন মেয়র আনিসুল হকের স্ত্রী রুবানা হক এসময় টুইট করেন ‘পুলিশ ইজ সারাউন্ডিং দ্য এরিয়া, গানফায়ার স্টিল অন’।

 

রাত সাড়ে ৯টা : গোলাগুলিতে আহত হন বনানী থানার ওসি মোহাম্মদ সালাউদ্দীন। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে।

 

রাত ১০টা : পুলিশ, র‍্যাব এবং আধা সামরিক

বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের কয়েকশ সদস্য ঘটনাস্থলে গিয়ে অবস্থান নেয়। গণমাধ্যমকর্মীরাও ৭৯ নং রোডের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থান নেন।

রাত সোয়া ১১টা : হাসপাতালে মারা যান বনানী থানার ওসি মোহাম্মদ সালাউদ্দীন।

 

রাত ৪টা পর্যন্ত অস্ত্রধারীদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ স্থাপন করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।

 

রাতেই ইসলামিক স্টেট জঙ্গি গোষ্ঠী তাদের বার্তাসংস্থা বলে পরিচিত ‘আমাক’-এ গুলশান হামলার দায় স্বীকার করে ২০ জন নিহত হওয়ার কথা জানায়। ৫ হামলাকারীর ছবি প্রকাশ করে।

 

উদ্ধার অভিযানের ঘটনাক্রম :

সকাল ৭টা ৩০ মিনিট : রাতভর হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্ট সংলগ্ন এলাকা ঘিরে রাখার পর সেনা, নৌ, পুলিশ, র‍্যাব এবং বিজিবির সমন্বয়ে যৌথ কমান্ডো দল গুলশানে অভিযানের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নেয়।

 

সকাল ৭টা ৪৫ মিনিট : কমান্ডো বাহিনী অভিযান শুরু করে। অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত দলের সদস্যরা রেস্টুরেন্টের ভেতরে প্রবেশ করে। এ সময় গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়।

 

সকাল সোয়া ৮টা : রেস্টুরেন্ট থেকে প্রথম দফায় নারী ও শিশুসহ ৬ জনকে উদ্ধার করা হয়। একজনকে অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে যাওয়া হয়।

 

৮টা ৫৫ মিনিট : ভবনের নিয়ন্ত্রণ নেয় অভিযানকারীরা। গোয়েন্দা দল ভবনের ভেতর বিস্ফোরকের জন্য তল্লাশি শুরু করে। কিছুক্ষণ পরই আলামত সংগ্রহের কাজ শুরু করে গোয়েন্দারা।

 

৯টা ১৫ মিনিট : অভিযান শেষ। কমান্ডো অভিযানের মধ্য দিয়ে হলি আর্টিজান বেকারিতে প্রায় ১২ ঘণ্টার রক্তাক্ত জিম্মি সংকটের অবসান হয়।

 

সকাল ১০টা : ৪ জন বিদেশিসহ ১৩ জন জীবিত উদ্ধারের খবর জানানো হয়। রেস্টুরেন্টের ভেতরে অজ্ঞাত ৫ জনের মৃতদেহ পাওয়ার কথা জানায় পুলিশ।

 

বেলা ১১টা ৫০ মিনিট : অভিযানে সন্ত্রাসীদের ৬ জন নিহত এবং একজন ধরা পড়েছে বলে নিশ্চিত করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

 

দুপুর ১টা ৩০ মিনিট : আইএসপিআর এক সংবাদ সম্মেলনে জানায়, রেস্টুরেন্ট থেকে ২০টি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।

Please Share This Post in Your Social Media
April 2024
T W T F S S M
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
30