নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি,মধ্যবিত্তের কপালে হাত
এম আব্দুল করিম,সিলেট থেকেঃ
এই যে, কিছুদিন আগেই আমাদের দেশে করোনা ভাইরাসের কী করুণ তাণ্ডব লীলা চলে গেল, এখনো কিছু কিছু এলাকায় লোকজন নতুন করে, তবে তুলনামূলক ভাবে কম কিন্তু আক্রান্ত হচ্ছে করুণ এ অদৃশ্য ভাইরাসে। আর একটি চরম সত্য হল যে,অদৃশ্য এ ভাইরাসের কারণে পুরো পৃথিবী আজ বিরাট অর্থনৈতিক মন্দায় নিপতিত।
আবার এদিকে শুরু হয়েছে দাম বৃদ্ধির প্রতিযোগিত। চাল, ডাল, আটা, ময়দা, ভোজ্যতেল, চিনি, আলু, পেঁয়াজ, শুকনা মরিচ, আদা, রসুন, হলুদ ও ডিম থেকে শুরু করে শাকসবজির দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। বলতে গেলে বেসামাল হয়ে গেছে নিত্যপন্নের বাজার। অপরদিকে মানুষের আয়-রোজগার আগের মত নেই। অস্বাভাবিক দামের জন্যে ভোক্তার জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। যদিও সরকার চাল ও আলুর দাম নির্ধারিত করে দিয়েছে। কিন্ত তা মানা হচ্ছে কমই।
মূলত গত ৮ মার্চ প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়, এরপর ২৬ মার্চ থেকে সরকার দেশব্যাপী সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। এতে নিত্যপণ্য ছাড়া অন্যান্য প্রতিষ্ঠান একে একে বন্ধ হয়ে যায়। একটানা ৬৬ দিন বন্ধ থাকে সরকারি-বেসরকারি অফিস। এতে অসংখ্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও শ্রমিককে বিনা নোটিসেই ছাঁটাই করা হয়। অনেকের বেতন ৫০ থেকে ৭৫ ভাগ কমানো হয় যা খুবই দুঃখজনক। অনেকেই শহরের বাসা ছেড়ে পাড়ি জমান গ্রামের বাড়িতে। ক্রমে লোকজনের চলাচল ও দোকানপাট ব্যবসা-বাণিজ্য যখন স্বাভাবিক হওয়া শুরু হল, ঠিক তখনই বাড়তে শুরু করল একে একে বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দাম।লাগামহীন এ তালিকা দিন দিন বেড়েই চলছে। আর এমতাবস্থায় অসহায় ভোক্তাগণ ক্রমাগতই দুর্বিষহ হয়ে পড়ছেন তাদের জীবনমান নিয়ে।
এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্টরা জানান যে, করোনাভাইরাস আক্রমণের প্রথমদিকে মানুষের মনে ভয়ভীতি ছিল। তখন নিত্যপণ্যের দামও সাধারণ মানুষের নাগালে ছিল। কিন্তু গত এক থেকে দেড় মাস ধরে বেড়েই চলেছে বিভিন্ন পণ্যের দাম। আলু,পেঁয়াজ, চাল, ডাল, ভোজ্যতেল ও সবজি থেকে শুরু করে সব পণ্যই সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। মানুষের আয়-রোজগারও আগের মত নেই, অন্যদিকে পণ্যের অস্বাভাবিক এ দাম বাড়ায় সাধারণ মানুষ তো কষ্টে আছেই এমনকি অবস্থাসম্পন্ন মানুষও স্বস্তিতে নেই।
গত এক থেকে দেড় মাস আগে রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রতি কেজি খোলা সয়াবিন তেলের দাম ছিল ৮৪-৮৫ টাকা। গতকাল তা বিক্রি হয়েছে ৯৬-৯৭ টাকায়। একইভাবে ৮০-৮২ টাকার সুপার পাম তেল এখন ৯২-৯৩ টাকা, ৭৫-৭৬ টাকার পাম তেল এখন ৯০-৯১ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ৫৫-৫৬ টাকার চিনি ৫৮-৫৯ টাকা, ১০০ টাকার দেশি মসুর ডাল ১০৮ থেকে ১১০ টাকা, ৫৮-৬০ টাকার মোটা দানার মসুর ডাল এখন ৬৬-৬৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ৪৫-৫০ টাকার পেঁয়াজ ৮০-৯০ টাকায়, ২৪-২৫ টাকার খোলা আটা ২৭-২৮ টাকা, ২৮-৩০ টাকার খোলা ময়দা ৩০-৩২ টাকা। সব ধরনের চালের দাম কেজিপ্রতি চার থেকে পাঁচ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। আলু বিক্রি হচ্ছে ৪৫ থেকে ৫০ টাকায়, ৩৫-৩৭ টাকার ডিম এখন ৩৭-৩৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত বিপণন সংস্থা (টিসিবি)’র হিসাব অনুযায়ী, গত এক মাসের ব্যবধানে প্রতি কেজি বিভিন্ন ধরনের চালে ছয় দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে ১২ দশমিক ৭৭ শতাংশ, আটা-ময়দায় এক দশমিক ৪৭ থেকে তিন দশমিক ১৭ শতাংশ, ভোজ্যতেল দুুই দশমিক শূন্য ছয় থেকে ১৪ দশমিক ৪৮ শতাংশ, মসুর ডাল তিন দশমিক ৫৭ শতাংশ থেকে পাঁচ দশমিক ৮৮ শতাংশ, আলু ২৭ দশমিক শূন্য তিন শতাংশ, শুকনা মরিচ ১০ দশমিক ৬৪ শতাংশ, হলুদ তিন দশমিক ৪৫ শতাংশ ও ডিম চার দশমিক এক শতাংশ দাম বেড়েছে।
পাইকারি আটা-ময়দা ব্যবসায়ীরা জানান, গত কয়েকদিনে আটা-ময়দার দাম বস্তাপ্রতি ৬০-১০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এক মাস আগে প্রতি ৫০ কেজি ওজনের এক বস্তা আটার দাম ছিল এক হাজার ৩০ থেকে এক হাজার ৫০ টাকা। গতকাল তা এক হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। একইভাবে এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজার ২৩০ টাকার ময়দার বস্তা গতকাল এক হাজার ৪৪০ থেকে এক হাজার ৪৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এছাড়া প্রতি বস্তা সিটি গ্রুপের ময়দা এক হাজার ৫৫০ টাকা এবং বসুন্ধরা এক হাজার ৪৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
এদিকে আগামীতে দাম আরও বাড়বে বলে জানান সিলেটের অনেক ব্যবসায়ি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিলেটের কিছু ভোজ্যতেল খুচরা ব্যবসায়ী জানান, বাজার এখন বেসামাল হয়ে গেছে। ভোজ্যতেলের ক্ষেত্রে সকালে এক দাম, দুপুরে আরেক দাম এবং বিকালে আরেক দামে তেল বিক্রি হচ্ছে।পাইকারি বাজারের অধিক মুনাফা লোভী কয়েকজন পরিবেশক এসব কারসাজি করছে। এতে খুচরা ব্যবসায়ী ও ভোক্তা ঠকছেন।
যেহারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে তাতে নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্ত তো কষ্টে আছেই, মধ্যবিত্ত পরিবারও নিদারুণ কষ্টে আছে বলে মনে করছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংগঠন ‘কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’ (ক্যাব)। সংগঠনের সভাপতি গোলাম রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে মানুষের আয়-রোজগার কমেছে। অন্যদিকে বাজারে প্রায় প্রতিটি নিত্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। এই অবস্থায় সরকারের উচিত হবে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানোর। কর্মসংস্থান তৈরির মাধ্যমে ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে হবে। আলু অস্বাভাবিক দামে বিক্রি হওয়ায় তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, অসাধু ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করে তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোঃ জাফর উদ্দীন বলেন, সরকার টিসিবির মাধ্যমে পেঁয়াজ আমদানি করায় দাম কমতে শুরু হয়েছে। আরও দুই লাখ টন পেঁয়াজ পাইপলাইনে রয়েছে। ভোজ্যতেল পরিশোধনাগারদের নিয়ে গত সপ্তাহে বৈঠক করা হয়েছে। দাম কমানোর প্রতিশ্রুতি তারা দিয়েছেন। খুচরা ও পাইকারি পর্যায়ে দাম বাড়লে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর সেটি দেখবে। নিত্যপণ্যের বাজার পরিস্থিতি নিয়ে আগামী রোববার মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করা হবে। সেখানে আলোচনার পর প্রয়োজনে সব ধরনের ব্যবসায়ীদের নিয়ে বৈঠক করা হবে বলে জানান তিনি।
সর্বোপরি এ বিষয়ে সরকারের আশু দৃষ্টিই সাধারণ জনগণ কামনা করছেন।