২৭শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৫শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি

মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক রাধিকা মোহন গোস্বামী’র ১৭তম মৃত্যু বার্ষিকী আজ

admin
প্রকাশিত সেপ্টেম্বর ২৮, ২০২২
মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক রাধিকা মোহন গোস্বামী’র ১৭তম মৃত্যু বার্ষিকী আজ

Sharing is caring!

সত্যজিৎ দাসঃ

বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রথম দিকের সংগঠক,শত শত স্বদেশি আন্দোলনের কর্মীদের নিরাপদ আশ্রয়দাতা,মৌলভীবাজার জেলার প্রথম নাট্যকার ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব স্বর্গীয় রমনীমোহন ভট্টাচার্য ওরফে রমনীমোহন গোস্বামী’র সুপুত্র ধীরেন্দ্র ভট্টাচার্য ওরফে রাধিকা মোহন গোস্বামী।

রাধিকা মোহন গোস্বামী ছিলেন মৌলভীবাজার জেলার একজন প্রথিতযশা সাংবাদিক ও বৃহত্তর সিলেটের একজন কৃতি সন্তান। পাকিস্তান আমলে ৫০ এর দশকে জাতীয় দৈনিক পূর্বদেশ ও ইংরেজি ইস্টার্ন হেরাল্ড এর মৌলবীবাজার মহকুমার নিজস্ব সংবাদদাতা ছিলেন। স্বাধীনতার পর তিনি বাংলাদেশের সরকারী বার্তা সংস্থা বাসস এর মহকুমা ও পরে মৌলবীবাজার জেলা সংবাদদাতা হিসেবে ২০০২ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন।

আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের প্রথম দিকে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে থাকলেও পরে ওয়ালী ন্যাপ ও  তারও পরে মোজাফফর ন্যাপ এর কেন্দ্রীয় প্রেসিডিয়াম এর সক্রিয় একজন হিসেবে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আসীন ছিলেন। বহুবিধ যোগ্যতা আর গুনের অধিকারী রাধিকা মোহন গোস্বামী কবিগুরুর শান্তি নিকেতন থেকে বিশ্ব ভারতী ডিগ্রি অর্জন করেন।

বাংলা সংস্কৃতিতে তিনি নাটক,সংগীত ও যন্ত্র সংগীতে নিপুণতার সাক্ষরও রেখেছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধে ” ন্যাপ কমিউনিস্ট পার্টি ছাত্র ইউনিয়ন “গেরিলা বাহিনীর একজন সক্রিয় সদস্য হিসেবে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। ত্রিপুরাতে ভারত বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা লিয়াজো কমিটিতে ও শরণার্থী শিবিরে কাজ করেছেন। হাজার হাজার তরুণ যুবকদের উৎসাহিত ও অনুপ্রেরণা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে তাদেরকে অংশগ্রহণ করতে কাজ করেছেন প্রশংসনীয় ভাবে ।
২০০৪ সালের ২৯ শে সেপ্টেম্বর বুধবার বার্ধক্য জনিত রোগে ৮১ বছর বয়সে তিনি পরলোক গমন করেন।

স্বর্গীয় রাধিকা মোহন গোস্বামী’র কনিষ্ঠ পুত্র রুপক কান্তি গোস্বামী বলেন,’আমার বাবা রাধিকা মোহন গোস্বামী একাত্তরের মহান স্বাধীনতা মুক্তিযুদ্ধে “ন্যাপ ছাত্র ইউনিয়ন কমিউনিস্ট পার্টির “গেরিলা বাহিনীর একজন মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের কৈলাশহর মুক্তিযুদ্ধ লিয়াজো কমিটির একজন সদস্য ও মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে এবং শরণার্থী শিবিরে কাজ করেছেন। তাঁর অনুপ্রেরণায় কয়েকশ ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী ও সাধারণ ঘরের অতি সাহসী যুবকরা যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলো বীরত্ব সহকারে ।

বাবা ছাত্র জীবনে ভারতীয় যুব কংগ্রেসের একজন সক্রিয় কর্মী হিসাবে রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন ও পরবর্তীতে পাকিস্তান আমলে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ওয়ালী) ও পরে ন্যাপ (মোজাফফর) এর কেন্দ্রীয় প্রেসিডিয়াম এর সক্রিয় একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত।

তদানীন্তন মৌলভীবাজার মহকুমার আওয়ামী লীগের প্রথম কমিটির ৩ জনের একজন আমার বাবা রাধিকা মোহন গোস্বামী। বাকী দু’জন হচ্ছেন প্রয়াত ব্যোমকেশ ঘোষ (টেমা বাবু) ও প্রয়াত সৈয়দ আমজদ আলী। ১৯৫৬ সালে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন সংগ্রামের দিনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সাহচর্য লাভ করেন। ৭৫ এর আগ পর্যন্ত তাদের সম্পর্ক ও যোগাযোগ অক্ষুণ্ণ ছিল ‘।
প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক রাধিকা মোহন গোস্বামী’র সুযোগ্য পুত্র সিনিয়র সাংবাদিক রজত কান্তি গোস্বামী বলেন,’আমার বাবা পাকিস্তান আমলে দৈনিক পূর্ব দেশ ও Estern Herald এর সাংবাদিকতা দিয়ে শুরু করে স্বাধীনতার পর ২০০২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) এর সাথে যুক্ত ছিলেন। ১৯৫৬ সালে ঢাকার রুপমহল সিনেমা হলে পাকিস্তান সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক আশ্রয় “পূর্ব পাকিস্তান সংখ্যালঘু মোর্চা” এবং স্বৈরাচারী কুখ্যাত এরশাদ এর আমলে সংবিধানে রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম আইন পাশের পর “হিন্দু বৌদ্ধ খৃষ্টান ঐক্য পরিষদ” গঠনে ব্যাপক ভূমিকা ও সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন।

সারা জীবন বিভিন্ন সময়ে প্রগতিশীল ও রাজনৈতিক প্রয়োজনে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন দেশের তরে ।
রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী সময়ে তিনি ” শান্তি নিকেতন” থেকে ” বিশ্ব ভারতী ” ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৫৫/৫৬ সালে মৌলভীবাজারের ষ্টীল ফটোগ্রাফির পথিকৃত চৌমুহনায় শিশির স্টুডিও এর স্বত্বাধিকারী শিশির সেনের অনুরোধ ও তত্ত্বাবধানে স্টিল ফটোগ্রাফির সব খুঁটি নাটি আয়ত্ব করে মৌলভীবাজার চৌমুহনাতেই মনি স্টুডিও নামে একটি দোকান করেন।

স্বৈরাচারী আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের সময় এ স্টুডিওটি ছিল বাম প্রগতিশীলদের আড্ডা স্থল।১৯৬৭ সালে মৌলভীবাজারে বঙ্গবন্ধুর আগমনের সব ব্যবস্থা তিনিই একা হাতে করেছিলেন। তৎকালীন রেজিয়া হোটেলে কর্মীদেরকে নিয়ে ঘরোয়া মিটিং ও রাতে থাকার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের রেস্ট হাউসে বঙ্গবন্ধুর রাতে থাকার জায়গা। পরদিন সকালে ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী আমাদের মৌলভীবাজারের জনপ্রিয় প্রয়াত নেতা জনাব আজিজুর রহমানকে বঙ্গবন্ধুর সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত করাটা ছিল তাঁর সবচেয়ে দূরদর্শী চিন্তার প্রমাণ।

মুক্তিযুদ্ধের সময় গেরিলা বাহিনীর একজন সদস্য হয়ে তিনি নিজে বিভিন্ন জায়গায় ক্যামেরা নিয়ে ছবি ও সংবাদ সংগ্রহে ঘুরে বেড়িয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের গ্রামের বাড়ি ও মৌলভীবাজার শহরের সেন্ট্রাল রোডের বাসা পাকিস্তানি হানাদার ও এ দেশীয় রাজাকার আলবদররা সম্পূর্ণ ধূলিসাৎ ও গুড়িয়ে দেয়। পাকিস্তান ন্যাশনাল ব্যাংকের লকারে শত শত ভরি সোনা ও নগদ টাকা যুদ্ধের পূর্বে জমা করে রাখলেও স্বাধীনতার পর কিছুই পাননি বাবা ‘।

আবার ১৯৬৯ সালে সমবায় ব্যাংক থেকে নিজ গ্রামের দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সাবলম্বী করার স্বপ্নে বিভোর হয়ে ৠণ বিতরণ করে যুদ্ধের শেষে সেই টাকাটা সুদে আসলে সব তার জায়গা জমিন বিক্রি করে পরিশোধ করতে হয়। বিশাল স্থাবর সম্পত্তি বেদখল হয়ে যায়, অনেক সম্পত্তি শত্রু সম্পত্তি ও ডিসির ১/১খতিয়ানে চলে যায়।

মৌলবীবাজার চক্ষু হাসপাতাল নির্মানের মূল কারিগর ছিলেন তিনি। যা আজ সারা দেশের মধ্যে একটি সুপ্রতিষ্ঠিত ও নামী দামী হাসপাতাল। হাসপাতাল তৈরির কিছুদিন পরেই যারা এই চক্ষু হাসপাতাল নির্মানে সরাসরি বিরোধীতা ও এর বিপক্ষে ছিলেন তারা হঠাৎ করে এর সর্ব্বেসর্বা ও দানশীল ব্যাক্তি হিসাবে সামনে এসে গেলেন,আর সাংবাদিক সৈয়দ আতাহার নছর ও রাধিকা মোহন ইচ্ছে করে ঘৃনায় সরে গেলেন।

তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের অনেক জায়গা সহ আরও কিছু সমাজতান্ত্রিক দেশে সফর করেন ।
১৯৫১ সালের ১৬ই মে পর্যন্ত (প্রজাস্বত্ব আইন পাশ ও জমিদারি প্রথার বিলুপ্তি) জমিদার আমার বাবা সারা জীবন সাদাসিধে জীবন যাপন করতেন। পরোপকার করতেন নীরবে,নিজেকে কোন দিন সামনে তুলে ধরতে পছন্দ করতেন না। দেশে ও বিদেশে তার অগনিত বন্ধুস্থানীয় ও শুভানুধ্যায়ীরা আজও  তাকে মনে করেন শ্রদ্ধা ও সম্মান এর সাথে।বার্ধক্য জনিত কারনে ৮১বছর বয়সে ২০০৪ সালের২৯শে সেপ্টেম্বর বুধবার তাঁকে আর এই পৃথিবীতে বাঁচিয়ে রাখা যায়নি।

২০২০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয় সাংবাদিক রাধিকা মোহন গোস্বামী স্মৃতি পদক প্রদান। সিলেট বিভাগের চার জেলায় কর্মরত সাংবাদিকদের মধ্য থেকে প্রিন্ট মিডিয়া (পত্রিকা) থেকে একজন ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া (টেলিভিশন) থেকে একজনসহ মোট দুইজন সাংবাদিককে প্রতি দুই বছর পরপর “সাংবাদিক রাধিকা মোহন গোস্বামী স্মৃতি পদক” প্রদান করা হয়।