২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২০শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

প্রতিবন্ধীদের প্রতি ভালোবাসা ও সহমর্মিতায় আসুন সবাই এগিয়ে আসি —

admin
প্রকাশিত অক্টোবর ১০, ২০২১
প্রতিবন্ধীদের প্রতি ভালোবাসা ও সহমর্মিতায় আসুন সবাই এগিয়ে আসি —

Sharing is caring!

প্রতিবন্ধীদের প্রতি ভালোবাসা ও সহমর্মিতায় আসুন সবাই এগিয়ে আসি —

 

প্রতিবেদক শেখ তিতুমীর আকাশ :-প্রতিবন্ধী অক্ষম মানুষেরা চিরকালই সমাজে সবলদের দ্বারা উপেক্ষিত ও অবহেলিত হয়ে আসছে। অথচ ইসলামের নির্দেশনা অনুযায়ী তাদের সঙ্গে সদাচরণ, সাহায্য-সহযোগিতা এবং অন্যদের ওপর তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। বিপদ-আপদে সব সময় তাদের পাশে দাঁড়ানো মানবতা ও ইমানি দায়িত্ব। প্রতিবন্ধীদের সঙ্গে অসদাচরণ, উপহাস, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ বা ঠাট্টা-তামাশা করা সৃষ্টিকে তথা আল্লাহকে উপহাস করার শামিল। শারীরিক, শ্রবণ, বাক্, বুদ্ধি ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের একটি অংশ জন্মগতভাবে প্রতিবন্ধী। অপর অংশ দুর্ঘটনার কারণে মানসিকভাবে প্রতিবন্ধিত্বের শিকার হয়। গর্ভাবস্থায় মায়ের দৈহিক কোনো ঘাটতি, পুষ্টিহীনতা বা অসুস্থতা, জন্মের পর বেড়ে ওঠার সময় অপুষ্টি, রোগাক্রান্ত হওয়া, সড়ক দুর্ঘটনা প্রভৃতিসহ পিতামাতার অমনোযোগ, অযত্ন ও অবহেলার কারণে শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তুমি তোমার সুমহান প্রতিপালকের নামের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করো, যিনি সৃষ্টি করেন ও সুঠাম করেন এবং যিনি পরিমিত বিকাশ সাধন করেন ও পথনির্দেশ করেন।’ (সূরা আল-আ’লা, আয়াত: ১-৩) অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তিনিই মাতৃগর্ভে যেভাবে ইচ্ছা তোমাদের আকৃতি গঠন করেন।’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৬)
সমাজে প্রতিবন্ধী মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ, স্বাভাবিক ও সম্মানজনক জীবনযাপনের অধিকার রয়েছে। প্রতিবন্ধীদের মানবিক মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে মানুষকে কর্তব্যপরায়ণ ও দায়িত্বসচেতন হওয়ার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। একজন প্রতিবন্ধী সমাজে সুস্থ-সুন্দরভাবে বিকশিত হয়, যদি দেশের অবকাঠামো ভালো হয়। ইসলাম মানুষকে হতদরিদ্র অসহায়ের প্রতি সহানুভূতি ও সাহায্য-সহযোগিতার শিক্ষা দেয়। প্রতিবন্ধীরা শারীরিক, মানসিক কিংবা আর্থসামাজিক অক্ষমতা বা অসুবিধার কারণে স্বাভাবিক ও স্বাবলম্বী জীবনযাপন করতে পারে না। প্রতিবন্ধীদের সীমাহীন দুঃখ-দুর্দশা উপলব্ধি করতে পারেন সেসব ধর্মপ্রাণ সংবেদনশীল মানুষ, যাঁরা অন্যের দুঃখ-বেদনাকে সহমর্মিতার দৃষ্টিতে দেখেন। এ জন্য প্রতিবন্ধীদের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা, দয়া-মায়া, সেবা-যত্ন, সুযোগ-সুবিধা ও সাহায্য-সহৃদয়তার হাত সম্প্রসারিত করা ইসলামের অনুসারীদের অবশ্যকর্তব্য। মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার ন্যূনতম মৌলিক অধিকারগুলো তাদেরও ন্যায্যপ্রাপ্য। তাই প্রতিবন্ধীদের প্রতি আন্তরিক ভালোবাসা প্রদর্শন ও সহানুভূতিশীল হওয়া অত্যাবশ্যক। যেমনভাবে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা ক্ষুধার্তকে খাদ্য দাও, অসুস্থ (প্রতিবন্ধী) ব্যক্তির খোঁজখবর নাও এবং বন্দীকে মুক্ত করে দাও।’ (বুখারি)
একদা রাসুলুল্লাহ (সা.) কুরাইশ নেতাদের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনারত ছিলেন। এমতাবস্থায় আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাক্তুম (রা.) নামক এক অন্ধ সাহাবি সেখানে উপস্থিত হয়ে মহানবী (সা.)-কে দ্বীন সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। এতে আলোচনায় ব্যাঘাত সৃষ্টি হলে তিনি কিঞ্চিৎ বিরক্তি প্রকাশ করেন। নবী করিম (সা.) মক্কার জাত্যভিমানী কুরাইশদের মন রক্ষার্থে প্রতিবন্ধী লোকটির প্রতি তখন ভ্রুক্ষেপ করলেন না। কিন্তু আল্লাহর কাছে এ বিষয়টি পছন্দনীয় হলো না। সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিবন্ধীদের অধিকারবিষয়ক পবিত্র কোরআনের আয়াত নাজিল হয়; যাতে তাদের প্রতি ইসলামের কোমল মনোভাবের প্রকাশ পেয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘সে ভ্রুকুঞ্চিত করল এবং মুখ ফিরিয়ে নিল, কারণ তার কাছে অন্ধ লোকটি এল। তুমি কেমন করে জানবে, সে হয়তো পরিশুদ্ধ হতো অথবা উপদেশ গ্রহণ করত। ফলে উপদেশ তার উপকারে আসত।’ (সূরা আবাসা, আয়াত: ১-৪)
এরপর নবী করিম (সা.) প্রতিবন্ধীদের সর্বদাই অত্যন্ত ভালোবাসতেন ও বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাক্তুম (রা.)-কে তিনি অপার স্নেহে ধন্য করেছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) যখনই তাঁকে দেখতেন, তখনই বলতেন, ‘স্বাগত জানাই তাঁকে, যাঁর সম্বন্ধে আমার প্রতিপালক আমাকে ভর্ৎসনা করেছেন।’ মহানবী (সা.) এ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সাহাবিকে দুবার মদিনার সাময়িক শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। সুতরাং প্রতিবন্ধীদের প্রতি ভালোবাসা ও সহমর্মিতা নবী করিম (সা.)-এর অনুপম সুন্নতও বটে। ঘটনাক্রমে রাসুলে করিম (সা.) যদি প্রতিবন্ধীকে অগ্রাধিকার না দেওয়ায় সতর্কীকরণের মুখে পড়তে পারেন, তাহলে ধর্মপ্রাণ মানুষ এমন কাজ করলে নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা অসন্তুষ্ট হবেন আর আল্লাহর অসন্তুষ্টি মানেই কঠোর শাস্তি।
সুতরাং সবাইকে খুবই সতর্ক হতে হবে এবং প্রতিবন্ধীদের প্রতি অবহেলা নয়, ভালোবাসা আর সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।
একজন মানুষ হিসেবে প্রতিবন্ধীদের নিশ্চয়ই স্বাভাবিক চলাফেরা করার অধিকার আছে এবং সবারই প্রতিবন্ধীদের অধিকারের প্রতি বিশেষভাবে নজর দেওয়ার দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। বিশেষ করে প্রতিবন্ধী নারী, শিশু ও বয়োবৃদ্ধদের বৈষম্য ও দুঃখ-কষ্টের সীমা থাকে না। তাই ইসলাম শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে দুর্বল অসহায় প্রতিবন্ধীদের অধিকারের ব্যাপারে যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছে। প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, স্বাস্থ্যসেবা, পুনর্বাসন, কর্মসংস্থান ও বিনোদন লাভের পূর্ণ অধিকারের কথা বলা হয়েছে। প্রতিবন্ধীরাও তাদের পিতামাতার প্রিয় সন্তান। তাদের মধ্যেও সুখ-দুঃখ, ব্যথা-বেদনা, স্নেহ-ভালোবাসা ও দেশপ্রেমের অনুভূতি আছে। এ জন্য দেশ গড়ার ক্ষেত্রে তাদের সম্পৃক্ত করতে হবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ, কর্মসংস্থান প্রভৃতি ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষায়িত কার্যক্রমের প্রয়োজন রয়েছে। প্রতিবন্ধীদের পরমুখাপেক্ষিতার পথ থেকে স্বাবলম্বিতার পথে আনা এবং সমাজের আর দশজন কর্মীর মতো তাদের হাতকেও কর্মীর হাতে পরিণত করার পদক্ষেপ নিতে হবে।
প্রতিবন্ধীরা সমাজের বোঝা নয়, তাদের মধ্যে রয়েছে আল্লাহ প্রদত্ত তীক্ষ্ণ মেধাসম্পন্ন অনন্য প্রতিভা। শারীরিক বা যেকোনো প্রতিবন্ধিতা অক্ষমতা নয়, বরং ভিন্ন ধরনের সক্ষমতা। সুযোগ পেলে প্রতিবন্ধীরাও দক্ষতা ও পারদর্শিতার মাধ্যমে অনেক কিছু করতে পারে। প্রতিবন্ধীদের মেধা ও প্রতিভাকে কাজে লাগাতে পারলে এরা মানবসম্পদে পরিণত হবে। সামর্থ্য অনুযায়ী বিভিন্ন যোগ্যতা অর্জনের মাধ্যমে দক্ষতা গড়ে তাদের স্বাবলম্বী করে তোলা যায়। সমাজের সব থেকে প্রান্তিক অংশ অসহায় প্রতিবন্ধীদের ইসলাম প্রদত্ত অধিকার সুরক্ষা হচ্ছে কি না, তা সবারই দেখা উচিত। মানবাধিকার, উপযুক্ত পরিচর্যা, অনুকূল পরিবেশ, আর্থিক সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও সমবেদনা পেলে তারা দেশ ও জাতি গঠনে যোগ্য অংশীদার হতে পারে। তাই আসুন না, আমরা প্রতিবন্ধীদের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা ও সহমর্মিতা প্রকাশে অত্যন্ত যত্নবান হই এবং তাদের মানবাধিকার সুরক্ষার ব্যাপারে সচেতন হই।
কোনো কোনো শিশুসন্তানের প্রতিবন্ধিতার বিষয়টি প্রথমদিকে খুব একটা বোঝা যায় না। বাসার স্বাভাবিক পরিবেশে তারা বেড়ে উঠছে, খেলাধুলা করছে, স্কুল-কলেজ ও মা-বাবার সঙ্গে বাইরেও যাচ্ছে; কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে কিছু কিছু মানসিক অসঙ্গতি লক্ষ করা যাচ্ছে।

মা-বাবার চোখে ধরা পড়লেও অনেক ক্ষেত্রে এ বিষয়গুলো কারও সঙ্গে শেয়ার করতে চান না। আত্মীয়স্বজন, পরিচিতজন বা যাদের সঙ্গে তাদের নিয়মিত ইন্টারঅ্যাকশন হচ্ছে, তারা কিন্তু খুব সহজেই বিষয়গুলো অনুভব করতে পারেন। যেহেতু মা-বাবাই এসব নিয়ে আলোচনা করতে চান না; তাই আত্মীয়স্বজনরাও কোনো কথা বলেন না। সবদিক থেকে পুরো বিষয়টিতে এক ধরনের মৌনতা অবলম্বন করা হয়।

এ সন্তানরা যখন কৈশোর, তারুণ্যে শারীরিকভাবে শক্ত-সামর্থ্য হয়, তখন অনেক ক্ষেত্রেই ঘরের মধ্যে জিনিসপত্র ভাংচুর ও কারণে-অকারণে চিৎকার-চেঁচামেচি করে। পরিবারের অন্য সদস্যদের, এমনকি মা-বাবাকেও মারধর করে। অনেক ক্ষেত্রে ওইসব শিশু আর দশটা শিশু থেকে লেখাপড়ায়ও ভালো হয়।

ফলে মা-বাবা ধরেই নেয় তার সন্তানের মানসিক কোনো সমস্যা নেই। অনেক সময় ভাবেন অতিরিক্ত মেধাবী হওয়ায় তার সামগ্রিক আচরণ আর পাঁচ-দশটা শিশু থেকে হয়তো ভিন্ন; কিন্তু বড় হলেই সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। সকালে ঘুম ভাঙা থেকে রাতে ঘুমোতে যাওয়া পর্যন্ত ওই সন্তানরা নিজের দৈনন্দিন কাজকর্ম মোটামুটিভাবে সম্পন্ন করতে পারলেও তাদের মাথার ওপর কাউকে না কাউকে থাকতেই হয়। আর এ দায়িত্বটি পরম বিশ্বস্ততা, আন্তরিকতা, স্নেহ-ভালোবাসা দিয়ে মা-বাবাই পালন করে থাকেন।

অভিভাবকরা ছোটবেলায় তাদের ডাক্তারের কাছে নেন না। সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই পড়ানো হয়, ফলে তাদের মেন্টাল ম্যাচিউরিটিতে সমস্যা থেকেইে যায়। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি বুঝে প্রতিক্রিয়া করার বিষয়টি বুঝে উঠতে পারে না। এতে পরিবারে অশান্তি ও অস্বস্তি দেখা দেয়।

অভিভাবকদের এ ব্যাপারে সচেতন ও বাস্তববাদী হতে হবে। ছোট বয়সে এ ধরনের সন্তানকে চিকিৎসা করানো ও তাদের উপযোগী প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া ও প্রশিক্ষণে অনেক বেশি ফল পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

প্রতিবন্ধীদের জীবনমান ও দক্ষতা উন্নয়নে বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করা হয়েছে। অন্যান্য দেশের মতো প্রতিবন্ধীদের অধিকার রক্ষায় বিভিন্ন ধরনের আইন প্রণয়ন, সজ্ঞায়িত ও শ্রেণিবিন্যাসও করা হয়েছে। প্রতিবন্ধিতা সম্পর্কে ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন-২০১৩’-তে বলা হচ্ছে ‘যে কোনো কারণে ঘটিত দীর্ঘমেয়াদি বা স্থায়ীভাবে কোনো ব্যক্তির শারীরিক, মানসিক, বুদ্ধিগত, বিকাশগত বা ইন্দ্রিয়গত ক্ষতিগ্রস্ততা বা প্রতিকূলতা এবং ওই ব্যক্তির প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিগত ও পরিবেশগত বাধার পারস্পরিক প্রভাব যার কারণে ওই ব্যক্তির সমতার ভিত্তিতে সমাজে পূর্ণ ও কার্যকর অংশগ্রহণে বাধাগ্রস্ত হয়’।