২১শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৯শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

“ইসলাম শান্তির ধর্ম” : কেন ও কীভাবে? আসুন জেনে নেই একটু…

admin
প্রকাশিত সেপ্টেম্বর ১২, ২০২১
“ইসলাম শান্তির ধর্ম” : কেন ও কীভাবে? আসুন জেনে নেই একটু…

Sharing is caring!

“ইসলাম শান্তির ধর্ম” : কেন ও কীভাবে?

লেখক শেখ তিতুমীর আকাশ :-‘ইসলাম শান্তির ধর্ম’ কথাটি মুসলিম মাত্রেরই মনের কথা এবং অতি সত্য ও বাস্তব কথা। তবে বহুল উচ্চারিত অনেক সত্য কথার মতো এ কথারও মর্ম ও বিস্তৃতি সঠিকভাবে উপলব্ধি করা প্রয়োজন। কারণ, সঠিক কথারও ভুল বা অসম্পূর্ণ অর্থ গ্রহণের সম্ভাবনা থাকে।

কুরআন মাজীদে আলকুরআনের তথা ইসলামের শিক্ষা ও বিধানের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে এভাবে-

 

…তোমাদের কাছে আল্লাহর নিকট থেকে এসেছে এক জ্যোতি ও স্পষ্ট কিতাব। যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি পেতে চায় এ দ্বারা তিনি তাদের শান্তির পথে পরিচালিত করেন এবং অন্ধকারসমূহ থেকে আলোর দিকে বের করে আনেন নিজ ইচ্ছায়। আর তাদের পথ দেখান সরল পথ। -সূরা মাইদা (৫) : ১৫-১৬

এ আয়াতে ‘সালাম’ শব্দ আছে। সাধারণত ‘সালাম’ শব্দের অর্থ করা হয় ‘শান্তি’। এ অর্থ ভুল নয়, তবে সূক্ষ্ম অর্থ হচ্ছে ‘মুক্তি’। বিপদ ও অশান্তি থেকে মুক্তিই তো শান্তির বড় উপায়। ইসলাম মানুষকে বিপদ ও অশান্তি থেকে মুক্তির পথ প্রদর্শন করে। তাই ইসলাম শান্তির ধর্ম।

ইসলামের কিতাব আলকুরআন মানুষকে নাজাতের পথ দেখায়। কী থেকে নাজাতের? প্রথমত আখিরাতের মহা বিপদ থেকে নাজাতের। ইসলামী আকীদার এক প্রধান বিষয় আখিরাতে ঈমান এবং ইসলামী শিক্ষা-দীক্ষার গোটা ব্যবস্থাটিই তাকওয়া (খোদাভীতি) ও ঈমান বিল আখিরাহ (আখিরাতের উপর ঈমান)-এর উপর ভিত্তিশীল। তেমনি ইসলামী দাওয়াতের প্রধান অংশ আখিরাত ও আখিরাতের নাজাত। ইসলামের নবী, বিশ্ব মানবতার নবী হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাওয়াতের অন্যতম প্রধান বিষয় ছিল আখিরাত এবং তাঁর গোটা জীবনের সফল সমুজ্জ্বল বিস্তৃত ও বিচিত্র দাওয়াতী কর্মতৎপরতার অন্তর্নিহিত ঐক্যের সূত্রটি ছিল আখিরাত। ইসলামের আকীদা-প্রসঙ্গ হোক বা ইবাদত, লেনদেন হোক বা সামাজিকতা, স্বভাব-চরিত্র হোক বা আচার-আচরণ, সৎকাজের আদেশ হোক বা অসৎকাজের নিষেধ এককথায় মানবজীবনের সব বিষয়ে ইসলামের যে বিশ্বাস ও বিধান তা গ্রহণ ও অনুসরণের মূল প্রেরণা আল্লাহর সন্তুষ্টি ও আখিরাতের নাজাত। এ কারণে ইসলামের করণীয়-বর্জনীয় সকল বিষয়ের সাথে যে পরিভাষাগুলো জড়িত তা হচ্ছে ছওয়াব ও গুনাহ, জান্নাত ও জাহান্নাম, আল্লাহর সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টি। ইসলামের কোন শিক্ষাটি এমন যেখানে পাপ-পুণ্যের, জান্নাত-জাহান্নামের এবং আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টির প্রসঙ্গ নেই?

ইসলামী দাওয়াতের শিরোনাম-বাক্য যদি হয় ‘আস্লিম তাস্লাম’ ‘ইসলাম কবুল কর নাজাত পাবে।’ তাহলে এই নাজাত প্রধানত আখিরাতের নাজাত। ইসলামের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আবির্ভাবের অন্যতম উদ্দেশ্য যদি হয়- ‘ইন্নী নাযীরুল লাকুম বাইনা ইয়াদাই আযাবিন শাদীদ’ (আমি এক কঠিন আযাবের পূর্বে তোমাদের হুঁশিয়ারকারী।) তাহলে এই আযাব প্রধানত আখিরাতের আযাব। সুতরাং ‘ইসলাম শান্তির ধর্ম’- কথাটির প্রধান মর্মবাণী আখিরাতের নাজাত ও শান্তি। অর্থাৎ ইসলাম ঐ ধর্ম যা আখিরাতের নাজাত ও শান্তির পথ প্রদর্শন করে। বরং একমাত্র ইসলামই ঐ ধর্ম যার মাধ্যমে আখিরাতে নাজাত পাওয়া যাবে।

 

কেউ ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো দ্বীন কবুল করতে চাইলে তার নিকট থেকে তা কখনও গ্রহণ করা হবে না। আর সে হবে আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ৮৫

এই মর্ম বিস্মৃত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

এ অর্থ অনুসারে ‘ইসলাম শান্তির ধর্ম’ কথাটিতে বিশ্বাসের দাবি, আখিরাতে নাজাতের যে পথ ইসলাম দেখায় সেই পথের পথিক হওয়া। ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী আপন আকীদা-বিশ্বাস দুরস্ত করা, আল্লাহর হক ও বান্দার হক সম্পর্কে জানা ও তা আদায় করা, সব রকমের গোনাহ ও পাপাচার থেকে এবং আল্লাহর হক ও বান্দার হক নষ্ট করা থেকে বিরত থাকা। মৃত্যু পর্যন্ত ইসলাম-নির্দেশিত পথে থেকে আখিরাতের চিরস্থায়ী শান্তির উপযুক্ত হওয়া।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ইসলাম কি শুধু আখেরাতের মুক্তির পথই প্রদর্শন করে? পার্থিব শান্তির উপায় নির্দেশ করে না? করে। ইসলাম পার্থিব শান্তি ও কল্যাণের পথও নির্দেশ করে। আর এ হচ্ছে ‘ইসলাম শান্তির ধর্ম’ কথাটির বিস্তৃত মর্মের দ্বিতীয় অংশ। শুরুতে সূরা মাইদার যে আয়াত উদ্ধৃত হয়েছে তাতে ‘সুবুলাস সালাম’ (মুক্তির পথসমূহ) শব্দবন্ধে পার্থিব মুক্তিও শামিল। এক্ষেত্রেও ইসলাম ঐ অদ্বিতীয় ধর্ম যাতে মানবজীবনের সকল ক্ষেত্রের এবং মানবজাতির সকল শ্রেণির যথার্থ শান্তি ও কল্যাণের পথনির্দেশ রয়েছে। এটা বোঝার জন্য ইসলামের এক একটি শিক্ষা ও বিধানের যথার্থতা নিয়ে নির্মোহ চিন্তা-ভাবনাই যথেষ্ট। তাহলে দেখা যাবে ইসলামের শিক্ষা ও বিধানের অনুসরণেই রয়েছে মানুষের ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবন এবং সামাজিক ও রাষ্ট্রিয় জীবনের শান্তি, স্বস্তি, নিরাপত্তা ও প্রশান্তির নিশ্চয়তা।

কে না জানে শান্তি ও প্রশান্তির কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে মানুষের মন। মনে যদি শান্তি থাকে তাহলে গোটা সত্তায় শান্তি বিরাজ করে। আর মন যদি অশান্ত হয় মানবের গোটা সত্তা অশান্তিতে আক্রান্ত হয়। মনের শান্তির একমাত্র উপায় আল্লাহর স্মরণ, তাঁর প্রতি আস্থা ও সমর্পণ এবং জীবন ও জগতের সকল বিষয়ে তাঁর ফয়সালায় সন্তুষ্টি। এই সম্পদ যে পেয়েছে জীবনে তার দুঃখ-কষ্ট থাকতে পারে, উপায়-উপকরণের স্বল্পতাও থাকতে পারে কিন্তু অশান্তি থাকে না। কারণ মহান আল্লাহ তার হৃদয়কে পরিতুষ্টি ও পরিতৃপ্তি দ্বারা পূর্ণ করে দেন। আল্লাহর প্রতি আস্থার অবলম্বনে তাঁর হৃদয় থাকে ভারমুক্ত ও শঙ্কামুক্ত। পক্ষান্তরে এই সম্পদ যে পায়নি ভোগের সকল উপকরণের মাঝেও সে শান্তি খুঁজে পায় না। অশান্তির আগুনে দগ্ধ হতে থাকে। কারণ তুষ্টি ও আনন্দ, আস্থার অবলম্বন ও ভারমুক্ততা এবং বিবেকের দংশন থেকে মুক্তির মতো শান্তির উপকরণগুলো থেকে তার হৃদয়-মন বঞ্চিত থাকে। মনের এই ক্ষোভ, অতৃপ্তি ও হাহাকারের বহিঃপ্রকাশ ঘটে তার কর্ম ও আচরণে। তার শিক্ষাহীন হৃদয়ের ঔদ্ধত্য, হিং¯্রতা, কুটিলতা ও কপটতা একে একে বাইরে বেরিয়ে আসতে থাকে এবং শুধু তাকেই নয়, তার আপনজন, প্রিয়জন, পাড়া-প্রতিবেশি, কর্তা-সহকর্মী অধীনস্ত সবাইকে সন্ত্রস্ত ও বিপদগ্রস্ত করে তোলে। ইসলামের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কত সত্য বলেছেন- ‘মানব-দেহে একটি মাংসপি- রয়েছে। যখন তা শুদ্ধ হয় গোটা দেহ শুদ্ধ হয় আর যখন তা নষ্ট হয় গোটা দেহ নষ্ট হয়ে যায়। শোনো, তা হচ্ছে কলব (হৃয়য়)

সামষ্টিক জীবনের শান্তি নির্ভর করে পারস্পরিক অধিকার রক্ষা এবং একের অস্তিত্ব অন্যের জন্য অশান্তির কারণ না হওয়ার উপর। তাই ব্যক্তির পরিশুদ্ধি তথা মানবীয় সুকুমারবৃত্তির বিকাশ, উন্নত গুণাবলির উৎকর্ষ, মন্দ প্রবণতাসমূহের নিয়ন্ত্রণ, পরস্পরের হক ও অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা এবং উত্তম পরিশীলিত আচরণ-উচ্চারণ অতি গুরুত্বপূর্ণ। আখলাক ও তাযকিয়া ইসলামী শিক্ষার এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। আখলাক তথা স্বভাব-চরিত্রের পরিশুদ্ধির সাথে ইসলামে অতি বিস্তৃতভাবে রয়েছে সামষ্টিক জীবনে পারস্পরিক কর্তব্য ও অধিকারের বর্ণনা ও শিক্ষা। তাই ‘আখলাক’ ও ‘মুআশারা’ ইসলামী শিক্ষা ও জীবন-ব্যবস্থার দুই গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। বর্তমান বিশ্বসভ্যতার জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যতটা অপরিহার্য পার্থিব জীবনের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য ইসলামের ‘আখলাক’ ও ‘মুআশারা’র শিক্ষা তার চেয়েও বেশি অপরিহার্য। এই শিক্ষার চর্চা ও অনুশীলনের মাধ্যমেই সূচিত হতে পারে সামষ্টিক জীবনের শান্তি ও স্বস্তি। সুতরাং ‘ইসলাম শান্তির ধর্ম’- এই বিশ্বাস ও উচ্চারণের দাবি, আল্লাহমুখিতা, আল্লাহর প্রতি আস্থা ও সমর্পণ, খোদাভীতি ও আখিরাতের জবাবদিহিতার অনুভূতির মতো বৈশিষ্ট্যগুলোর পাশাপাশি ইসলামী আখলাক ও মুআশারা তথা ইসলামী স্বভাব-চরিত্র ও সামষ্টিক জীবনের ইসলামী নীতি ও বিধানের চর্চা ও অনুশীলন।

 

এরপর শান্তির জন্য শুধু শিষ্টের ও শিষ্টতার লালনই যথেষ্ট নয়, দুষ্টের ও দুষ্টপ্রবণতার দমনও অপরিহার্য। তাই শান্তির ধর্ম ইসলামে রয়েছে হদ-কিসাস-তাযীরের মতো নানা বিধান। রয়েছে নাহি আনিল মুনকার ও জিহাদের বিধান। এগুলো ইসলামের স্বতন্ত্র ও বিস্তৃত অধ্যায়। রাষ্ট্রের ক্ষমতাশীলদের দায়িত্ব এসব বিধানের জ্ঞান যথাযথভাবে অর্জন করে সেগুলো বাস্তবায়ন করা। এই অধ্যায়ের নীতি ও বিধানের সঠিক উপলব্ধি ও যথার্থ প্রয়োগ সামাজিক শান্তি ও শৃংখলা এবং ন্যায় ও সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য অপরিহার্য। এমনিভাবে নাগরিকদের ফৌজদারী অপরাধের বিচারের পাশপাশি এটাও নিশ্চিত হওয়া দরকার যে, ক্ষমতাবানগণ কর্তৃক যেন এমন কোনো অপরাধ সংঘটিত না হয়। হত্যা, গুপ্তহত্যা, গুম, খুনের মত অপরাধগুলো যেন কারো থেকেই সংঘটিত না হয়। । সুতরাং ‘ইসলাম শান্তির ধর্ম’- এই বিশ্বাস ও উচ্চারণের এক দাবি, ইসলামের নাহি আনিল মুনকারের নীতি ও বিধানের যথার্থতা উপলব্ধি এবং স্ব স্ব ক্ষেত্রে ইসলামের বিধান অনুসারে এর চর্চা ও অনুশীলন।

এক কথায় ইসলাম বাস্তব অর্থে শান্তির ধর্ম। যে কেউ কোনো কিছুকে শান্তি মনে করে; ইসলামকে ঐ অর্থে শান্তির ধর্ম মনে করা ভুল। অন্যায় অনাচার, অশ্লীলতা, জুলুম-অবিচার হিংস্রতা ইত্যাদিকে কেউ যদি ‘শান্তি’ মনে করে তাহলে ইসলাম ঐ অর্থে শান্তির ধর্ম নয়। কারণ এগুলো ‘শান্তি’ নয়, নির্বিচার ইচ্ছা পূরণ মাত্র, যা দুনিয়া আখেরাতের চূড়ান্ত অশান্তির কারণ।

মুমিনের প্রতি কুরআন মাজীদের ইরশাদ-

হে মুমিনগণ! তোমরা সর্বাত্মকভাবে ইসলামে প্রবেশ কর এবং শয়তানের পদাংক অনুসরণ করো না। নিশ্চয় সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। -সূরা বাকারা (২) : ২০৮

সুতরাং মুমিনের কর্তব্য, পূর্ণাঙ্গভাবে ইসলামে প্রবেশ করা এবং জীবনের সকল অঙ্গনে ইসলামের সঠিক শিক্ষা ও বিধানের চর্চা ও বিস্তারে ব্রতী হওয়া। তাহলে আল্লাহর ইচ্ছায় আমাদের জীবনে পূর্ণ শান্তি বিরাজ করবে এবং ইসলাম শান্তির ধর্ম কথাটির সত্যতা ও যথার্থতা বাস্তবরূপে প্রতিফলিত হবে।

আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে ইসলামের পূর্ণ অনুসারী করুন এবং দুনিয়া ও আখিরাতের পূর্ণ শান্তি দান করুন