Sharing is caring!
ছাতক থানাধীন জাউয়াবাজার পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের এসঅাই মো. সোহেল রানার মানবিকতার অনন্য দৃষ্ঠান্ত
পুলিশ সত্যিকারের বিপদের বন্ধু।।
২৮/০৯/২০২০ইং তারিখ সারাদিন বিরামহীন অক্লান্ত পরিশ্রম। সন্ধ্যার পরে একটু সময় অফিসে কাজ। যথারীতি রাতের ডিউটিতে রওয়ানা। সাথে দুই কনষ্টেবল মোশাহিদ ও সাকুল ইসলাম এবং এক সিএনজি গাড়ী ড্রাইভার।
রাত ০১.৪৫ ঘটিকায় (২৯/০৯/২০২০ইং) সিএনজি গাড়ী যোগে ডিউটি চলছে। গাড়ী চলছে গ্রামের পর গ্রাম। কখনও মহাসড়ক, কখনও গায়ের মেঠো পথ।
রাতের আধারে কিছু কিছু গাছে ঝিঝি পোকার শব্দ আবার কোথাও পানিতে ব্যাঙ্গের ডাক। যেন মাঝে মাঝে শুনশান নিরবতায় ছন্দপতন। ঘুমের ঘোরে আচ্ছন্ন জনপদ। সভ্যতার আর্শিবাদ হিসেবে মাঝে মাঝে দুই এক বাড়ীতে বৈদ্যুতিক লাইট জ্বলছে।
ঘুমন্ত মানুষের অনেকে হয়তো জানে না তাহার বাড়ী ঘর এবং তাহার এলাকা রাতের বেলায় পুলিশ পাহারা দিচ্ছে আপন মনে। কখনও আবার অসৎ উদ্দেশ্যে ঘুরে বেড়ানো দুই একজনকে পুলিশ রাস্তায় দেখলে তাহাদের নাম ঠিকানা পরিচয় জিজ্ঞাসা করিলে মনে হয় পুলিশের কোন কাজ নেই অযথা তাহাদের বিরক্তির কারন হয়ে দাঁড়ায়। তবুও জনসাধারনের জান মালের নিরাপত্তায় রাতের আধারে ঘুরে বেড়ানো পুলিশের এক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। আমিও দায়িত্ববোধ থেকেই রাতের ডিউটি করছি। এদিক ওদিক লাইট জ্বালিলে দেখিছি।
ছাতক থানাধীন বড়কাপন পয়েন্ট হইতে গ্রামের ভিতর দিয়ে বড়কাপন বাজার যাচ্ছি। এমন সময় বড়কাপন পয়েন্ট হইতে একটু ভিতরে নির্মানাধীন নতুন মসজিদের পাশে রাস্তায় লুঙ্গি আধা ভেজা একজন বয়স্ক পুরুষ মানুষকে টর্চ লাইট হাতে দাঁড়িয়ে কি যেন খুজতে দেখতে পাই। সিএনজি ড্রাইভারকে গাড়ী দাঁড় করার কথা বলতেই লোকটির পাশে গাড়ী দাঁড়ায় ।
এত রাতে রাস্তায় কেন জিজ্ঞেস করতেই তখন লোকটি এগিয়ে এসে পাবলিক প্যাসেঞ্জার মনে করে বলতে থাকে তার একটি গাড়ী খুবই দরকার। কেন দরকার বলতেই লোকটি কান্নার আবেগ নিয়ে বলতে থাকে তাহার একটি সিএনজি গাড়ী খুবই দরকার ।
একজন রোগীকে হাসপাতালে নিতে হইবে। এরই মধ্যে একজন বয়স্ক মহিলা এসেও তার পাশে দাঁড়ায়। । সেও পুরুষটির গলায় সুর মিলিয়ে গাড়ীর প্রয়োজনীয়তা বলে। পুরুষটি বলে মহিলাটি তার স্ত্রী। গাড়ী থেকে নেমে কথা বলার একপর্যায়ে জানতে পারলাম পুরুষটির নাম আশিক মিয়া। তাহার ছেলে মানিক মিয়ার স্ত্রীর প্রসব বেদনা উঠেছে। একখনই হাসপাতালে নেওয়া জরুরী। অন্যথায় বিপদ ঘটিতে পারে। তাহাদের কথা শুনে আমি কিছুটা বিচলিত হয়ে গেলাম। এত রাতে … যাই হোক।
মনে মনে ভাবি আকুতি মিনতি করে আমাদের সিএনজি গাড়ী নিয়ে নাকি আবার আমাদের বিপদে ফেলবে। আমরা সংখ্যায় চার জন। আমি ও আমার সাথে দুই কনস্টেবল আর এক ড্রাইভার। যাই হোক বিপদ আসলে আসুক অসীম সাহসের সহিত বিষয়টি একটু দেখি। তাহাদেরকে সিএনজি গাড়ীর সহযোগীতার জন্য পরিচিত দু/তিন জন গাড়ীর ড্রাইভারকে ফোন দিলাম। কেউ ধরে নি। ধরবেই বা কেন এত রাতে পুলিশের ফোন । যাই হোক কোন একদিন পুলিশ ডিউটি করা এক পরিচিত ড্রাইভার নাম ফরিদ সে আমার কল ধরে। তাহাকে গাড়ী প্রয়োজনীতা বলার পর সে বলল তাহার এক মামাত বোন একই সমস্যা সেও বর্তমানে কৈতক হাসপাতালে আছে।
তাহাকে আসার জন্য বলিলে সে কোন কর্ণপাত না করিয়া আসার সম্মতি জানায়। এরই মাঝে আশিক মিয়াও তাহার স্ত্রীকে পুত্রবধু নিয়ে আসার জন্য বলিলে তারা দ্রুত চলে যায়। মিনিট দশেক হলো কেহ আসে না। ভাবলাম আবার কোন বিপদে না পড়তে যাচ্ছি। বুকে সাহস নিয়ে তাহাদের জন্য অপেক্ষা করছি। কিছুক্ষন পর এক ছোট নৌকায় করে ৪/৫ জন মহিলা ও আশিক মিয়া আসে। সত্যিই তাহার পুত্রবধুর অবস্থা খারাপ দেখিয়া আমার খুব খারাপ লাগে। বিবেক তাড়িত হয়ে নিজের বিপদের কথা ভূলে যাই।
আমার যাই হোক আগে মানুষকে বাঁচাতে হবে। যেই কথা সেই কাজ। আমাদের ডিউটি সিএনজি গাড়ী তাহাদেরকে দিয়ে দিলাম। তাহাদের লোক বেশী হওয়ায় একজন মহিলা আমাদের সাথে থেকে যায়। আশিক মিয়াকে তাহার পুত্রবধু ও সাথে থাকা মহিলাদেরকে নিয়ে দ্রুত কৈতক হাসপাতালে যাইতে বলি। পরে আমরা পাঁয়ে হেটে বড়কাপন পয়েন্টে আসি।
এরই মধ্যে আমার ফোন করা সিএনজি ড্রাইভার ফরিদ আমাদের কাছে আসে। আমি সংগীয় কনষ্টেবল ও সাথে থাকা মহিলাকে নিয়ে দ্রুত হাসপাতালে যাই। হাসপাতালের গেইট লাগানো। মনে হল দায়িত্ব শুধু পুলিশেরই। পাবলিকের টাকায় শুধু পুলিশের বেতন হয়। অন্যান্য সরকারী কর্মচারীর বেতন মঙ্গল গ্রহ থেকে আসে। যাই হোক কিছুক্ষন ডাকাডাকির পর একজন হাসপাতালের গেইট খুলে দেয়। দ্রুত আশিক মিয়ার পুত্রবধুকে নিয়ে মহিলা ওয়ার্ডে তুলে দেই।
রোগীর ঔষধপত্র কেনা ও জরুরী প্রয়োজনে সিলেট নিয়ে যাওয়া সহ যে কোন প্রয়োজনে আমাদেরকে ডাকতে বলিয়া আশিক মিয়াও তাহার লোকজন থেকে আমরা যথারীতি আবার ডিউটিতে চলে আসি।
অনুমান ১৫/২০ মিনিট পর হাসপাতালে থাকা সিএনজি ড্রাইভার ফরিদ এর ফোন। আমার কলিজা ধরফর করে উঠল। না জানি কোন সমস্যা। ফরিদ আমাকে জানায় স্যার আপনি যে মহিলাকে নিয়ে হাসপাতালে আসছিলেন তার একটি মেয়ে বাচ্চা হয়েছে। খুবই সুন্দর। তার কথা আলহামদুলিল্লাহ বলে একটি দীর্ঘশ্বাস নিলাম। আল্লাহ হেফাজতের মালিক।
নিজেকে আর ধরে রাখতে পারি নি। পুনরায় সংগীয় পুলিশ সদস্য সহ হাসপাতালে গেলাম। নবাগত সন্তান নিয়ে মা বসে আছে। আমাদেরকে দেখে আশিক মিয়া ও তাহার স্ত্রী এক পর্যায়ে কেঁদেই দিল। আমাদের এই ঋণ কখনও ভুলবে না। পুলিশ সত্যিকারের বিপদের বন্ধু, পুলিশের মধ্যেও ভাল মানুষ আছে.. ইত্যাদি সহ আরো অনেক কিছু বিড়বিড় করে বলতে লাগল।
আবেগ আপ্লুত হয়ে নিজেকে কোন রকমে সংযত করে নিলাম। তাহাদের ভালবাসায় কিছুক্ষনের জন্য আপন মানুষ হয়ে গেলাম। নিজের মানিব্যাগ বের করে পাঁচশত টাকার এক নোট বের করে আশিক মিয়ার হাতে দিয়ে বললাম এত রাতে আমার পক্ষথেকে কিছুই দেয়ার নাই তবে আপনি নবাগত নাতনির জন্য কিছু একটা কিনে নিবেন। নিতে চায়নি তবুও জোড় করে দিলাম।
রাতের বাকি সময়টুকু হাসপাতালে থেকে সকাল হলে ডাক্তারকে দেখিয়ে বাচ্চাকে নিয়ে বাড়ী যাওয়ার জন্য পরামর্শ দিয়ে তাহাদের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। ডিউটি শেষে রুমে এসে বার বার তাহাদের কথা মনে পড়ছিল। তাৎক্ষনিক যদি আমাদেরকে না পেত তাহলে তাহাদের অপূরনীয় ক্ষতি হইতে পারত।
আল্লাহ দয়াশীয়। বাঁচানো মালিক। বিপদে মানুষের উপকার করতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে হল তাই বিষয়টি লিখলাম। হয়তো অন্য কারো বিপদে আমি বা আমার মত আরো পুলিশ এগিয়ে আসবে সহজ সরল মানুষের পাশে এটাই প্রত্যাশা করি।
এসআই সোহেল রানার ফেসবুকের টাইমলাইন থেকে নেয়া।