Sharing is caring!
আশুলিয়ার গাজীরচটে অভিযোগের অন্ত নেই
দখল ও চাঁদাবাজিতে পটু মঈনুল মেম্বার
মোস্তফা ইমরুল কায়েস
অভিযোগ ডেস্ক : আশুলিয়ার ধামসোনা ইউনিয়নের উত্তর গাজীরচটের ৭নং ওয়ার্ড মেম্বার মঈনুল ইসলাম ভুঁইয়া (৩৮)।
তার বাবা মৃত আব্দুস সালাম তেমন কিছু রেখে যায়নি। তারও তেমন কিছুই ছিল না। কিন্তু গত ১০ বছরে সে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার আসার পর তার ভাগ্য বদলাতে শুরু করে। ইপিজেড এলাকায় রাতারাতি দুটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি দখল করে কোটিপতি বনে যায়।
শুরু করে ঝুট ব্যবসা। এখানেই থেমে থাকেনি। স্থানীয় যুবলীগের যুগ্ম আহŸায়কের পদ বাগিয়ে নিয়ে রাজনৈতিক পরিচয়ে শুরু করে দখল ও ত্রাসের রাজত্ব। এলাকায় কোনো নতুন জমি কেউ কিনলেই তার চোখ পড়ে সেখানে ছুটে গিয়ে লোকজন নিয়ে বাধা দেয়। জমি দখল নিতে না পারলে আদায় করে মোটা অঙ্কের চাঁদা।
আর চাঁদা না দিতে পারলে ভুক্তভোগীর ভাগ্যে জোটে হুমকি ও হামলা। হামলায় পঙ্গুত্ববরণ করেছেন এমনও ভুক্তভোগীকে পাওয়া গেছে।
এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যক্তিকে সরকারি চাকরি ও ব্যবসা করিয়ে দেওয়ার নামে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে মঈনুল। মঈনুলের এসব অপকর্মের জন্য রয়েছে বিশাল ক্যাডার বাহিনী। এই বাহিনীর অন্যতম ক্যাডার হলো মঈনুলের সহযোগী দক্ষিণ বাইপাইল চাড়ালপাড়ার হরমুজ আলীর ছেলে যুবলীগ নেতা ফরহাদ হোসেন সোহাগ (২৮) ও ধামসোনা ইউনিয়ন যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক একং দক্ষিণ গাজীরচটের আনোয়ার হোসেনের ছেলে কাইয়ুম (২৯)। এ ছাড়া রয়েছে তার অঘোষিত ম্যানেজার হিসেবে কাজ করে সুজন, ওই এলাকার যুবলীগ নেতা সেলিম মÐল ও কবির সরকার। তার বিরুদ্ধে আশুলিয়া থানায় চারটির বেশি মামলা থাকলেও তাকে গ্রেফতার করা হয় না।
এলাকাবাসী, ভুক্তভোগী ও থানা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, মঈনুল ইসলাম ভ‚ঁইয়া একজন ইউপি সদস্য হলেও চলে বিশাল বাহিনী নিয়ে। তার দাপট, দখল আর অত্যাচারে অতিষ্ঠ মানুষজন। কোনো ফাঁকা পতিত জমি দেখলেই তার নজর পড়ে।
এ ছাড়া এলাকায় চাঁদাবাজি, মাদক ও অন্যকে হামলার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগ নিয়ে আশুলিয়া থানায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ব্যক্তি অভিযোগও করেছেন কিন্তু কোনোটার বিচার বা সুরাহা হয়নি। এমনকি তাকেসহ তার কোনো সহযোগীকে ধরাও হয়নি। কখনও জামিনে আবার কখনও পলাতক জীবন নিয়েই এলাকায় তারা দাপটের সঙ্গে চলাফেরা করে। মঈনুলের অন্যতম সহযোগী ফরহাদ হোসেন সোহাগ। যার বিরুদ্ধে থানায় নারী ও শিশুধর্ষণ, মাদক ও চাঁদাবাজিসহ প্রায় ১০টিরও বেশি মামলা রয়েছে।
এলাকাবাসী ও ভুক্তভোগী আরও জানায়, ইউপি সদস্য মঈনুলের এলাকায় তার অনুমতি ছাড়া কাউকে কিছু করতে দেয় না সে। তার কথাতেই সব হয়। স্থানীয় যুবকদের নিয়ে গড়ে তুলেছে ক্যাডার বাহিনী। মঈনুল বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাঁদাবাজিও করে। চাঁদা না দিলেই নেমে আসে নির্যাতন ও এলাকা ছাড়ার হুমকি। এসব অপকর্ম মঈনুল ও তার সহযোগীরা দীর্ঘদিন ধরে করে আসছিল। সম্প্রতি অনেকে মুখ খুলছেন।
তেমন একজন ভুক্তভোগী আশুলিয়ার বাইপাইল এলাকার মাকসুদা বেগম। তার দোকান ও জমি দখলের জন্য বিভিন্নভাবে তারা চেষ্টাও চালায়। চলতি বছরের গত ৫ ফেব্রæয়ারি মাকসুদা তার দোকান, মার্কেট ও জমি দেখাশোনার জন্য গেলে তাকে পেয়ে ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে মঈনুল ও তার লোকজন। চাঁদা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে তারা মাকসুদাকে একা পেয়ে মারধর করে।
তার পা ও হাতে কুপিয়ে আহত করে। পরে ওই নারীকে উদ্ধার করে স্থানীয়রা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে। এ ঘটনায় ৭ ফেব্রæয়ারি একটি মামলাও হয়। কিন্তু বিচার হয়নি। মঈনুল ও অন্যতম সহযোগী যুবলীগ নেতা সোহাগসহ অন্যরা দাপটের সঙ্গেই এলাকায় ঘুরছে।
একই সমস্যায় পড়েন ঢাকা জেলার মহিলা আওয়ামী লীগের নেত্রী তাসলিমা শেখ লিমা। তিনি জানান, জমি কিনে ভবন তৈরির কাজ করছিলেন। সেখানে গিয়ে মঈনুলের ম্যানেজার সুজন বাধা দেয়। একপর্যায় বিষয়টি ঢাকা জেলার পুলিশ সুপারকে জানালে তদন্তে আসল ঘটনা বেরিয়ে আসে। পিছু হটে মইনুলের লোকজন। লিমা সময়ের আলোকে জানান, ‘সম্প্রতি মঈনুল মেম্বার, কবির সরকার ও সেলিম মÐল আমাকে হুমকি দিয়েছে।
তারা বলেছে, যতদিন এসপি আছে, ততদিন তুই ওই জমিতে থাকতে পারবি। কিন্তু মনে রাখিস, এসপি চলে গেলে তোকে আর থাকতে দেওয়া হবে না।’ এ হুমকির পর থেকে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন তিনি।
সর্বশেষ তারা গত মার্চে স্থানীয় যুবলীগ নেত্রী মনিকা হাসানের ডিশ ব্যবসায় বাধা দেয়। মনিকার গ্রাহকের কাছ থেকে জোরপূর্বক টাকা তুলে নিত তারা।
এসব নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বিষয়টি জানালে ক্ষেপে যায় মঈনুল মেম্বার। গত ৭ মার্চ দিনদুপুরে মনিকার বাসার সামনে একা পেয়ে রড, লাঠি, হকস্টিক ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে হাতে ও পায়ে কুপিয়ে আহত করে মেম্বার মঈনুল, সোহাগ, সুজন, কাইয়ুমসহ মেম্বারের সহযোগীরা। এরপর তিন মাস হাসপাতালে ছিলেন মনিকা।
এখনও পঙ্গুত্ব জীবনযাপন করছেন তিনি। হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরলেও আতঙ্ক ছাড়ছে না। মনিকা হাসান সময়ের আলোকে জানান, তার জীবন এখন সঙ্কটাপন্ন। যেকোনো সময় আবারও তাকে হামলা করা হতে পারে। কারণ মঈনুল মেম্বার ও সোহাগের লোকজন তাকে সব সময় নজরদারি করছে।
তবে এসব থেকে পরিত্রাণ পেতে সম্প্রতি ঢাকা জেলার ডিআইজি বরাবরে আবেদন জানিয়েছেন বলে জানান তিনি। এ ছাড়া এই মঈনুল তার লোকজন দিয়ে রাতারাতি আশুলিয়ার বগড়াবাড়ি এলাকার বগাবাড়ি বাজারের আমবাড়ী বাগান এলাকার থাই নিটস বাটন ও নতুন ইপিজেড এলাকার এসবি নিটিং নামে দুটি গার্মেন্টস কারখানা দখলে নেয়। এখনও সেই দুটি গার্মেন্টস ফিরে পায়নি মালিকরা। বিষয়টি ওই এলাকার সবার মুখে মুখে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মঈনুলের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও দখলের পাশাপাশি এলাকায় স্বজনদের দিয়ে মাদক ব্যবসারও অভিযোগ রয়েছে। মঈনুলের ভাবি নাজমুন নাহার (মামলা নং-৩৭/২০১৭), বড়বোন আয়েশা বেগম (মামলা নং-১৩/২০১৪), বড়বোনের জামাই মো. শহীদ ভ‚ঁইয়া (মামলা নং-৫৫/২০১৭), শহীদ ভ‚ঁইয়ার ছেলে রাজু ও বড় ভাইয়ের ছেলে জাহিদ মিয়া (মামলা নং-৮৯/২০১৮) ও আফজাল হোসেন ভাগনি জামাই (মামলা নং-৩৭-২০১৭)। তাদের প্রত্যেকের নামে আশুলিয়া থানায় মাদকের মামলা রয়েছে।
কিন্তু তারা দিব্যি মঈনুলের পরিচয় ও আশ্রয়-প্রশ্রয়ে মাদকের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। এলাকাবাসী ভয়ে কোনো প্রতিবাদও করে না। মঈনুলের বিরুদ্ধে রয়েছে নারী কেলেঙ্কারিও। বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে একাধিক নারীর সঙ্গে দৈহিক সম্পর্কের অভিযোগও রয়েছে। আশুলিয়ার সোনিয়া মার্কেটের পাশে থাকা লাভলী নামে এক নারীর বাসায় নিয়মিত মদ ও নারীর আসর বসায় এই মঈনুল মেম্বার ও সোহাগ। এলাকাবাসী বলছেÑ মঈনুল, সোহাগ, কবির, সেলিম, কাইয়ুম ও সুজনের অত্যাচারে তারা অতিষ্ঠ।
মঈনুলের অন্যতম সহযোগী যুবলীগ নেতা সোহাগ। তারও তেমন কিছুই ছিল না। কিন্তু এলাকায় সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, দখল ও মাদক ব্যবসা করে এখন মোটরসাইকেল হাঁকিয়ে বেড়ায়। সোহাগের বিরুদ্ধে নারী ধর্ষণ, মাদক, চাঁদাবাজি ও হত্যাচেষ্টাসহ ১০টির মতো মামলা রয়েছে। কিন্তু পুলিশ তাকে গ্রেফতারও করে না। কিছুদিন আগে সে এক স্কুলছাত্রীকে জোর করে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করে এই সোহাগ। (আশুলিয়া থানা, মামলা নং-১৫/২০১৬)। ভুক্তভোগীর মা সময়ের আলোকে জানান, আমরা গরিব মানুষ। স্বামী নেই। মেয়েটাকে নিয়ে ভালো একটা স্বপ্ন দেখতাম। কিন্তু সোহাগ সব শেষ করে দিল। থানায় মামলা করলাম। কিন্তু পুলিশ তাকে ধরলও না।
এখন উল্টো ভয়ে থাকি। সোহাগ আমার মেয়ের জীবনটা নষ্ট করল। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমি এর বিচার চাই। এর আগেও এই সোহাগের হাত থেকে রক্ষা পায়নি আরেক নারী। তিনিও থানায় মামলা করেছিলেন কিন্তু সোহাগের কিছু হয়নি। উল্টো এই দুই পরিবারকে মামলা তুলে নেওয়ার জন্য বিভিন্নভাবে হুমকি দিয়ে যাচ্ছে সোহাগ।
সোহাগ এলাকায় চাঁদাবাজি করে থাকে। সোহাগের ভাই ওসমানও একজন এলাকার চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী বলে এলাকাবাসী জানিয়েছে। তবে এ ব্যাপারে স্থানীয় যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ভয়ে মঈনুলের বিরুদ্ধে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
ধামসোনা ইউনিয়নের গাজীরচট ৭নং ওয়ার্ড মেম্বার মঈনুল ইসলাম ভ‚ঁইয়া ও যুবলীগ নেতা সোহাগের সঙ্গে সময়ের আলোর পক্ষ থেকে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করলে ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।