২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২০শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

মাতামুহুরী সেতুর আত্মকথা

admin
প্রকাশিত জুলাই ৩, ২০১৯
মাতামুহুরী সেতুর আত্মকথা

Sharing is caring!

 

আব্দুল করিম চট্টগ্রাম জেলা প্রতিনিধি ঃ-

আমি এক জনম-দুঃখী কপাল পোড়া সেতুর জীবন্ত নমুনা। যৌবনের জৌলুস হারিয়ে গেছে বহু আগে। তারপরও ক’দিন আগে বুড়ির চর্মসার ঠোটে লিপস্টিক লাগানোর মত লাল-সাদা রঙে আমাকে সাজানো হলো। তার আগে চলেছে দূরারোগ্য ক্ষতের উপর চামড়া প্রতিস্থাপন আর মলম লাগানোর কাজ। গেল রমজানে পাঁজরের ভাঙ্গা হাঁড়ে জোড়া লাগানোর কাজটিও নতুনভাবে করা হয়েছে। হাঁটুর পুরোনো ফাঁটলে আবার চিড় ধরায় বালির বস্তা সরিয়ে নিয়ে নতুন করে কৃত্রিম হাঁটু প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। আমার দেহের ক্ষত সারানোর জন্য পাথরের কংক্রিট ও বিটুমিনের প্রলেপ দিলেও গাডির চাকার ঘর্ষণে সেগুলো উঠে গিয়ে আমার সারা গায়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকায় আমার জীর্ণতাকে আরও প্রকটাকারে প্রকাশ করছে।

আমি বহু কষ্টে চরম ধৈর্যধারণ করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমার শরীরের উপর দিয়ে চলমান বাহনগুলোর ভার বহন করে আসছি। বারবার ব্যাথার পট্টি আর মলম লাগানোর কারণে আমার শরীরের টেম্পার নষ্ট হয়ে গেছে, মেরামতকৃত অংশের জয়েন্ট ধরে রাখার মত ফিটনেস আমার নেই। তারপরও কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে আমাকে যন্ত্রণাদায়ক অপারেশন করে ব্যবহারের ব্যর্থ চেষ্টা কেন করা হয় সেটা আমার বুঝে আসে না। বার্ধক্যজনিত কারণে এমনিতেই আমাকে লাটিতে ঠেস দিয়ে দাঁড়াতে হয়। তার উপর চাপিয়ে দেয়া বোঝার ভার বহন করা কি আমার দ্বারা সম্ভব? এই নড়বড়ে শরীর নিয়ে আমি আর পারছি না। খানা-খন্দক থাকায় ধীরগতিতে চলাচল, যানজট আর জনদূর্ভোগের কারণে আমাকে মানুষের গালমন্দ শুনতে হয়, আমার অক্ষমতা নিয়ে সংবাদ ও সামাজিক মিডিয়াতে নানা রকম বিদ্রুপাত্মক হাস্য-রসাত্মক আলোচনা ও লেখালেখি হয়, এতে আমার কি দোষ?

আমার অবস্থা মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় কর্তৃপক্ষ উভয় প্রান্তে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি স্থাপন করলেও ভারী মালবাহী যানবাহনগুলোর অধিকাংশই তার তোয়াক্কা করে না, তাদের দানবীয় চলাচলে আমি ভয়ে থরথর করে শুধুই কাঁপতে থাকি। নিরাপত্তার খাতিরে ভারী যানবাহনের জন্য পেকুয়া-চৌমুহনী দিয়ে বিকল্প রাস্তা থাকলেও একমাত্র সেনাবাহীনির গাড়িগুলোই সেটা অনূসরণ করে বিধায় আমি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। তবে পাবলিক পরিবহনের কোন কোন চালকের বিবেকহীনতা আমাকে ভাবিয়ে তোলে। সেখানে কি আর চব্বিশ ঘন্টা পাহারা দিয়ে রাখা যাবে? জানমালের নিরাপত্তা ও যাতায়াতের সুবিধার স্বার্থে আজ শেষ বারের মত আমার অব্যক্ত বেদনাগুলো প্রকাশ করে আমি দায়মুক্ত হতে চাই।

প্রতিদিন চাতক পক্ষীর মত চোখ মেলে ডানে বামে তাকিয়ে থাকি, আমার পাশে নতুন কোন স্থাপনার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হয় কি’না। কিন্তু আমার আশা পূর্ণ হয় না। মনে প্রশ্ন জাগে, আমাকে তিলে তিলে যন্ত্রণা দিয়ে কি আত্ম-হননে বাধ্য করা হচ্ছে? আমি স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই, আর মরণের আগে অন্য কাউকে আমার দায়িত্ব অর্পণ করে শান্তিতে চলে যেতে চাই। যে কোন সময় আমার আয়ু শেষ হয়ে গেলে বা আমার শরীরের কোন অংশ হঠাৎ ভেঙে পড়লে জনগণের যে ভোগান্তি হতে পারে তা অনুমান করলেও গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়! বিশেষ করে অতি বর্ষণে উজান থেকে বিপদসীমা অতিক্রম করে ধেয়ে আসা জল-প্রবাহের ধাক্কা সামলাতে আমার বড্ড ভয় হয়। আমি কোন অঘটন চাই না। তাই মরার আগে আমার শেষ আকুতি, আমি আমার জীবদ্দশায় আমার বিকল্প হিসাবে আমারই পাশে নতুন একটি সেতু দেখে যেতে চাই!