Sharing is caring!
রচনায়-মোঃমিজানুর রহমান (কবি ডা.মিজান মাওলা) : চার দশক ধরে বাংলাদেশে বন্যা একটা নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১৯৫৪ ও ’৫৫ সালের বন্যা মানুষের মনে যে ক্ষত সৃষ্টি করেছিল, তা আজও বিভীষিকারূপে বিরাজ করে।
১৯৬৪ ও ১৯৭০ সালের বন্যায় গোটা দেশ প্লাবিত হয়েছিল। অগণিত মানুষ ও গবাদিপশুর ক্ষতি হয়েছিল খুব তখন। ১৯৭৪ সালের বন্যায় বাংলাদেশের ৬৪ জেলার ১৭টি জেলায় ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ১৯৮৭ সালের বন্যায় দেশের এক-তৃতীয়াংশ এলাকা পানির নিচে নিমজ্জিত হয়েছিল। ১৯৮৮ সালের বন্যা ছিল স্মরণকালের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ ও দীর্ঘস্থায়ী আঘাত।
৮৮ সালের বন্যায় দেশের ৫৩টি জেলার ৩৫১ উপজেলা বন্যাকবলিত হয়েছিল। এ বন্যায় ৯০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা প্লাবিত হয়েছিল।
দেশের ৫ কোটির মতো মানুষ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। অনেকের মতে, ২০০৪ সালের বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ’৮৮ সালের চেয়ে বেশি ছিল।
যদিও ২০০৪ সালের বন্যায় প্রাণহানি হয়েছিল কম; কিন্তু ক্ষতির পরিমাণটা ছিল প্রসারিত। সরকারের এক হিসাব মতে, ওই বন্যায় প্রায় ৭০০ কোটি ডলার বা ৪২ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ ক্ষতি হয়েছিল।
জাতিসংঘের হিসাবে এ পরিমাণ দেখানো হয়েছিল ৬৬০ কোটি ডলারের মতো। কৃষি মন্ত্রণালয় দেখিয়েছিল ৮.৩০ লাখ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত ও ছন্নছাড়া হন ৪৬.৫০ লাখ কৃষক। এছাড়াও ব্রিজ, কালভার্ট,রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ, মাদরাসাসহ অর্থনৈতিক অবকাঠামোর ব্যাপক পরিমাণ ক্ষতি সাধিত হয়। প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম দুই ধরনের কারণে বন্যা হয়ে থাকে।
বর্ষাকালে মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে অতিরিক্ত বর্ষণের সৃষ্টি হয়। ফলে নদ-নদী, খাল-বিল, ডোবা-নালা, মাঠ-প্রান্তর পানি দ্বারা ছাপিত হয়ে যায়। বাংলাদেশের অধিকাংশ নদ-নদীর উৎস হিমালয়।
মাত্রাতিরিক্ত বরফ গলার কারণেও ভারত, নেপাল থেকে অতিরিক্ত পানি এসে একত্রে মিশার কারণে বন্যা হয়। দেশের নদ-নদীর তলদেশে পলিমাটি পড়ে ভরাট হওয়ার কারণে নদ-নদীর পানি সামান্য বৃষ্টিতেই ফুঁসে ওঠে। কিছু নদীর গতিপথ পরিবর্তন হওয়ায়ও বন্যার সৃষ্টি হয়। অববাহিকার ওপর দিয়ে প্রতি বছর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণের ফলে নদীর স্বাভাবিক গতি ও পানি বহন ক্ষমতা ক্রমাগত কমে যায়। যেটা কিনা বন্যা সৃষ্টির অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে। ভূতত্ত্ববিদদের মতে, বিগত ভূমিকম্পের ফলে বাংলাদেশের নদীগুলোর তলদেশ বেশ খানেকটা উচ্চতাপ্রাপ্ত হয়েছে। ফলে অতি সহজে অল্প পানির চাপেও বন্যার সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
উপরোক্ত কারণ ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো অতিরিক্ত বৃষ্টি। অতিরিক্ত বৃষ্টির ফলেই অধিকাংশ বন্যার সূত্রপাত ঘটে। নির্বিচারে বন উজাড় করায় পরিবেশ তার স্বাভাবিক ভারসাম্য হারাচ্ছে।
শুধু তা-ই নয়, অপরিকল্পিত ইটের ভাটা, কলকার খানার বিষাক্ত ধোঁয়া গিয়ে বায়ুম-লে মিশে পরিবেশের স্বাভাবিক ভারসাম্য নষ্ট করে। ভারি বৃষ্টিপাত ঘটাতে সাহায্য করছে। যার জন্য ফি বছরই বন্যার আগমন পরিলক্ষিত ভয়াবহ ও জটিল এ সমস্যা থেকে বাঁচতে এবং দেশে অর্থনীতিকে বাঁচাতে সর্বগ্রাসী এ বন্যা নামের কালো অধ্যায়ের একটা স্থায়ী সমাধান আমাদের মতো মধ্য আয়ের দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বন্যা নিয়ন্ত্রণে দেশের নদীগুলোর নাব্য বৃদ্ধি ও সংস্কারের ব্যবস্থা করতে পারলে নদীর পানি ধারণক্ষমতা এবং পানিপ্রবাহের ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।
ফলে বন্যা নিয়ন্ত্রিত হবে। দেশের নদীর সঙ্গে সম্পৃক্ত খালগুলোকে পুনরায় খনন করে পানি নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা করতে হবে। পরিকল্পিত উপায়ে রাস্তাঘাট, বাঁধ ও সেতু নির্মাণ করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, যেন নদীর স্বাভাবিক প্রবাহে কোনো বাধার সৃষ্টি না হয়। নদীর দুই তীরের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ করা যেতে পারে। সুবিধামতো নদীর গতিপথ পরিবর্তন করে দিলে পানি সোজাসুজি প্রবাহিত হতে পারে এবং এতে বন্যার আশঙ্কা কম থাকে। বন্যার পানি প্রবেশের উৎসমুখ হলো হিমালয়। আর তাই তো বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য পার্শ¦বর্তী দেশ নেপাল-ভারতের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে এগিয়ে যেতে হবে।
ফারাক্কা বাঁধ তৈরি করার মাধ্যমে ভারত পানি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে যে সমস্যার সৃষ্টি করেছে, সেটার একটা আন্তর্জাতিক মীমাংসা করতে হবে।
সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো, দেশের বিভিন্ন জায়গায় সরকারি উদ্যোগে প্রচুর পরিমাণে গাছপালা লাগাতে হবে। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি প্রতিটি সচেতন নাগরিককেই চোখ-কান খোলা রেখে সম্মুখপানে অগ্রসর হতে হবে। তাহলে এ দেশের বন্যার আশঙ্কা বহুলাংশে হ্রাস পাবে।
(রচনা কাল:১১/১১/২০১৯ই)