২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, ১৯শে রমজান, ১৪৪৫ হিজরি

আবারও কার্যকর হওয়ার পথে ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’

অভিযোগ
প্রকাশিত অক্টোবর ২১, ২০১৯
আবারও কার্যকর হওয়ার পথে ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’

অভিযোগ ডেস্ক :: একাদশ জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশীয় রাজনীতিতে আলোচনা জন্ম দেয়া জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট আবারও কার্যকর হওয়ার পথে চলতে শুরু করেছে। নির্বাচন পরবর্তী সময়ে হঠাৎ করেই দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তির এ জোট নিজের কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে।

আর জোট নেতারাও জোটের নিষ্ক্রিয়তার জন্য একে অন্যকে দোষারোপ করে আসছিলেন। কিন্তু বিগত মাসখানেক সময় ধরে আবারও জোটটি সক্রিয়তার প্রমাণ দিতে পেরেছে বলে মনে করছেন জোট নেতারা। তারা আশাবাদী বিএনপি, গণফোরাম, জেএসডি, নাগরিক ঐক্যসহ অন্য কয়েকটি দলের সমন্বয়ে এ জোট খুব দ্রুত নিজের হারানো সক্রিয়তা ফিরে পাবে। একই সঙ্গে দেশের রাজনীতিতে একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের লক্ষ্যে বিরোধী দলগুলো যে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, তাতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে সফল হবে।

জোটের রাজনীতির দিকে লক্ষ করলে দেখা যায়, দেশের রাজনীতিতে হেভিওয়েট নেতাদের নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গত ৩০ ডিসেম্বর দেশের একাদশ জাতীয় নির্বাচনের পর হঠাৎ করেই কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। নির্বাচন পরবর্তী কর্মকাণ্ডে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট শুধু প্রেসরিলিজ, বিবৃতি ও কাগুজে জোট হিসেবে টিকে থাকার চেষ্টা করে। নির্বাচন পরবর্তীতে এ ফ্রন্টের কোনো কর্মকাণ্ড রাজনৈতিক ময়দানে ছিল না বললেই চলে। যদিও ফ্রন্টের প্রধান শরিক বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কখনই জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে অকার্যকর ও নিষ্ক্রিয় মানতে চাননি। তার দাবি ফ্রন্ট চলমান আছে। শরিকদের মধ্যে ঐক্যও আছে। ভবিষ্যতে বৃহৎ পরিসরে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট রাজনীতির মাঠে তাদের কর্মসূচি নিয়ে হাজির হবে বলেও তিনি বারবার বলে আসছিলেন।

কিন্তু, বিএনপি মহাসচিব দাবি করলেও নির্বাচন পরবর্তী সময়ে রাজনীতির মাঠে আপাতদৃষ্টিতে সত্যিকার অর্থে কার্যকর ছিল না নির্বাচনকে সামনে রেখে গড়ে উঠা সরকারবিরোধী জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে। নির্বাচনকে সামনে রেখে ছোট-বড় বিভিন্ন দলের সমন্বয়ে এ জোটটি তৈরি হলেও নির্বাচনের পর তা অনেকটা হারিয়ে যেতে থাকে চোরাবালিতে। সরকারবিরোধী আন্দোলন কিংবা কোনো জন ইস্যুতেই ভূমিকা দেখা যাচ্ছিল না এ জোটের। মাঝে মাঝে শুধু সংবাদ বিজ্ঞপ্তি, বিবৃতি দিয়ে জানান দিচ্ছিল নিজের অবস্থান।

সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচন পরবর্তীতে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের কর্মকাণ্ড নিয়ে বিরক্ত হয়ে পড়ে শরিক দলগুলো। দেশে ভয়াবহ বন্যা ও ডেঙ্গু সমস্যা নিয়ে জোটের কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। কার্যত সাধারণের কাছে ঐক্যফ্রন্টের অবস্থান রীতিমতো ঝাপসা হয়ে যায়, কেউ কেউ বলতে থাকেন এটি শুধুমাত্র নামেই ঐক্যফ্রন্ট। আসলে নেতাকর্মীদের ভেতরে কোনো ঐক্য নেই। জনবান্ধব কোনো ইস্যুতে নেই তাদের কোনো প্রতিক্রিয়া, দীর্ঘদিন ধরে নেই কোনো কর্মসূচি। নিজেদের মধ্যেও নেই কোনো কথাবার্তা। নেতাদের নিজেদের মধ্যেও নেই কোনো যোগাযোগ। কিন্তু সেই দেয়াল কাটিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নিকট অতীতে আবারও সক্রিয় হয়ে উঠছে। বিশেষ করে আবরার ইস্যুর পর ফ্রন্ট স্বল্প সময়েই বেশ কয়েকটি বৈঠক ও কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। মানববন্ধন, আলোচনা সভা করেছে। এ ছাড়াও ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জোট নেতারা কারাবন্দি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে দেখতে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এসব কর্মকাণ্ড নতুন করে আলোচিত এ জোটের সক্রিয়তার প্রমাণ হিসেবেই দেখছেন অনেকে।

কারাবন্দি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে দেখতে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালেও যাবেন। সাক্ষাতের অনুমতির জন্য সোমবার (২১ অক্টোবর) ঐক্যফ্রন্ট নেতা আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বে ৮ সদস্যের প্রতিনিধি দল সচিবালয়ে গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে দেখা করেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাদের জানিয়েছেন, খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে কারও বাধা নেই। ড. কামালসহ সবাই একসঙ্গে অথবা বিচ্ছিন্নভাবে তারা সবাই দেখা করতে পারবেন।

বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে কার্যকর জোটে পরিণত করতে দলের হাইকমান্ড নতুন করে নির্দেশনা দিয়েছেন। এ কারণে বিএনপিও আগের চেয়ে ঐক্যফ্রন্টকে নিয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। মহাসচিবের অবর্তমানে ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে দলের স্থায়ী কমিটির নতুন সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুকে। টুকুকে দেখা হয় দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ হিসেবে। এর বাইরে মতিঝিলে ড. কামাল হোসেনের চেম্বারে ফ্রন্টের স্থায়ী কমিটির গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে আরও যোগ দেন বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য কেন্দ্রীয় নেতা জহির উদ্দিন স্বপন। বিএনপিতে স্বপনের তাত্ত্বিক নেতা হিসেবে ব্যাপক সুনাম আছে।

রাজনৈতিক সূত্রে জানায়, নির্বাচন কমিশনে বর্তমানে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল ৩৯টি। গত নির্বাচনের সময় প্রায় ১৪টি দল ছিল সক্রিয়। নির্বাচনকে সামনে রেখে নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত প্রায় ১৫২টি রাজনৈতিক দল মিলে গঠিত হয়েছিল ১৪ রাজনৈতিক জোট। এর মধ্যে অন্যতম ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। বঙ্গবন্ধুর একসময়ের ঘনিষ্ঠ সহচর সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা ড. কামাল হোসেনকে প্রধান নেতা মেনে ওই ফ্রন্টে যোগ দেয় জিয়াউর রহমানের হাতে গড়া দল বিএনপি, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বাধীন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), মুক্তিযুদ্ধের জীবন্ত কিংবদন্তি আবদুল কাদের সিদ্দিকির নেতৃত্বাধীন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, এক সময়ের প্রখ্যাত ছাত্রনেতা ডাকসুর দুবারের সাবেক ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্নার নেতৃত্বাধীন নাগরিক ঐক্য। সঙ্গে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরাম ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের মধ্যে গণস্বাস্থ্যর প্রতিষ্ঠাতা মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও ইংরেজি দৈনিক নিউ নেশনের মালিক ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনসহ অন্যরা এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হন।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট সক্রিয় হয়ে তার লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দাবি করেছেন ফ্রন্টের অন্যতম শরিক নাগরিক ঐক্যর আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না। তিনি বলেন, যেভাবেই দেখি বা বলি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট মাঝে তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলেছিল। এ থেকে আমরা উঠে আসার চেষ্টা করছি। কারণ একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে চাইলে সকলের সম্মিলিত ঐক্যের বিকল্প নেই। সেই উপলব্ধি থেকেই জোট নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করছে। সক্রিয় হচ্ছে।

জোট সূত্রে জানা যায়, ঐক্যফ্রন্ট গঠনে বিএনপির পুরনো বন্ধু বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও ২০ দল ক্ষুব্ধ ছিল। তাদের মন রক্ষায় তারা কিছুটা ধীরে চলো নীতিতে এগোতে থাকে।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সাম্প্রতিক কার্যক্রম যাচাই করে দেখা যায়, ৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনের পর তিনটি কর্মসূচি ডেকেছিল জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। এর মধ্যে প্রথমটি ছিল চলতি বছরের মার্চে। খালেদা জিয়ার মুক্তি, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি ও পুনর্নির্বাচনের দাবিতে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করার কথা ছিল তাদের। তবে মানববন্ধনের আগের দিন ‘প্রেস ক্লাবের সড়কে খোঁড়াখুঁড়ির অজুহাতে’ তা বাতিল করা হয়। ৩১ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের একটি আলোচনা অনুষ্ঠান আয়োজনের ঘোষণা দিয়ে পরে ‘হল বরাদ্দ পাওয়া যায়নি’ বলে সেটিও বাতিল করা হয়। ধর্ষণের প্রতিবাদ করায় ফেনীর সোনাগাজীতে আগুন দিয়ে হত্যা করা নিহত শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফি হত্যায় গত ২৪ এপ্রিল শাহবাগ চত্বরে গণজমায়েতের ডাক দেয় জোটটি। তবে একদিন আগে ‘অনিবার্য কারণবশত’ সেটিও বাতিল করা হয়। সর্বশেষ বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার হত্যার প্রতিবাদে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ২২ অক্টোবর (মঙ্গলবার) শোক সমাবেশের কর্মসূচি দেয়া হয়েছিল। তবে সমাবেশের অনুমতি না পাওয়ায় এ কর্মসূচি থেকেও সরে এসেছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট।

সূত্রে জানা যায়, কার্যত ফ্রন্টের প্রধান নেতা ড. কামাল হোসেন সম্পর্কে বিএনপি ও অন্য শরিকদের মধ্যে নির্বাচন পরবর্তী সময়ে কিছুটা ভুল ধারণা তৈরি হয়। সেই ধারণা থেকেই ধীরে ধীরে জোটটি নিষ্ক্রিয়তার দিকে যেতে থাকে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন ইস্যুতে ড. কামাল সম্পর্কে সেই ভুল ধারণা কাটতে শুরু করায় শরিকরাও সক্রিয় হয়ে উঠছেন। যার বহিঃপ্রকাশ ঘন ঘন জোটের বৈঠক ও বৈঠকে শীর্ষ নেতাদের উপস্থিতি।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতা ও গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, জনগণ অবশ্যই বিরোধী দলগুলোর ঐক্য আশা করে। তাদের জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ও রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখা উচিত। জনবিরোধী নানা সিদ্ধান্তে কর্মসূচি দিয়ে জনগণের পাশে থাকতে হবে। আমি মনে করি, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় ঐক্যফ্রন্টের ঐক্য অটুট রেখে সবাইকে এক হতে হবে।

বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা জহির উদ্দিন স্বপন বলেন, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে কার্যকর ও আরও সক্রিয় করতে কাজ চলছে। এখনই যে ঐক্যফ্রন্ট খুব দাঁড়িয়ে গেছে, ব্যাপারটা তা নয়। আমাদের একটা ফর্মুলা বের করতে হবে। ফ্রন্টের শরিকরা তো জামায়াতের ব্যাপারে নেগেটিভ। আমাদের ঐক্যফ্রন্টসহ সবাইকে লাগবে। আবার জামায়াতের সঙ্গেও দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। বিএনপির কৌশলগতভাবে কী করবে তা স্থায়ী কমিটি সিদ্ধান্ত নেবে। তারাই ঠিক করবে কীভাবে সমস্যাটা সমাধান করবে।

Please Share This Post in Your Social Media
March 2024
T W T F S S M
 1234
567891011
12131415161718
19202122232425
262728293031