Sharing is caring!
অভিযোগ ডেস্ক :: যুবলীগকে ভোগ করা চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীর মাথা থেকে অবশেষে মুকুট খসে পড়ল।
নানা অভিযোগ মাথায় নিয়ে শেখ হাসিনার নির্দেশে তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।
সংগঠনে লাগামহীন নিয়ন্ত্রণ, ক্যাসিনোকে প্রশ্রয়, টেন্ডার বাণিজ্যসহ নানা অনিয়মই তার পতনের মূল কারণ।
এত সব অভিযোগে যেকোনো সময় তিনি গ্রেফতারও হতে পারে বলে আভাস পাওয়া গেছে।
এর আগে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব যুবলীগের সম্মেলন ‘৭ম কংগ্রেস’ বিষয়ে তাগাদা দিয়েছেন।
কিন্তু লাগামহীন নিয়ন্ত্রণের কারণে যথাসময়ে তা দেয়া হয়নি।
সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী ক্ষোভ প্রকাশ করে সম্মেলন দিতে নির্দেশ দেন।
যুবলীগের আগামী কংগ্রেসের বিষয়ে চূড়ান্ত দিক-নির্দেশনা নিতে রোববার (২০ অক্টোবর) আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে গণভবনে বৈঠক বসেন সংগঠনের শীর্ষ নেতারা।
বৈঠকে ৭ বছর আটকে থাকা নেতাকর্মীরা একে একে ওমর ফারুকের বিরুধ্যে সকল অভিযোগ উত্থাপন করেন আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড শেখ হাসিনার কাছে।
সবশেষে নানান অভিযোগ মাথায় নিয়ে যুবলীগের চেয়ারম্যান পদ থেকে ওমর ফারুক চৌধুরীকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।
৭ম কংগ্রেস উপলক্ষে যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য চয়ন ইসলামকে সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক ও সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশিদকে সদস্য সচিবের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
ওমর ফারুক চৌধুরী বিড়ি শ্রমিক লীগ, জাতীয় পার্টি যুব সংগঠন, আওয়ামী লীগ করেও লম্বা সময় ছিলেন পেছনের কাতারে।
তবে যুবলীগের সভাপতি হওয়ার পর পুরনো ব্যর্থতার দেনা শোধ করেছেন।
এমনই রূপকথার মতো ওমর ফারুকের উত্থান।
তামাক দিয়ে ব্যবসা শুরু করলেও একসময় করেন তৈরি পোশাকের ব্যবসা।
কিন্তু ব্যবসায় সাফল্য পাননি তিনি। হয়েছেন ঋণখেলাপি।
তবে যুবলীগের সভাপতি হয়েই ভাগ্য বদলে যায় তার। যদিও তার দৃশ্যমান কোনো ব্যবসা বা আয়ের উৎস নেই।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অন্যতম সহযোগী সংগঠন যুবলীগ।
সংগঠন আওয়ামী লীগের হলেও দীর্ঘ ৭ বছর যাবৎ একক নিয়ন্ত্রণ করেছেন ওমর ফারুক চৌধুরী।
তার কথাই শেষ কথা ছিল যুবলীগে। তার ইচ্ছায় চলত সংগঠনটির কেন্দ্র থেকে সারা বাংলাদেশ।
এ নিয়ে নেতাকর্মীদের ক্ষোভ থাকলেও প্রকাশ হয়নি কখনো।
সম্প্রতি সরকারের ক্যাসিনো বিরোধী অভিযানে ক্যাসিনোর নিয়ন্ত্রণের প্রভাব পড়ে যুবলীগর ওপর।
একে একে যুবলীগের শীর্ষ একাধিক নেতা গ্রেফতার পওয়ার পরে আঙুল ওঠে সংগঠনের চেয়ারম্যানের উপর। ৭ বছরের সহ্য করা ক্ষোভও প্রকাশ করতে থাকেন নেতাকর্মীরা।
কেন্দ্র থেকে তৃণমূল- সব জায়গায় গঠনতন্ত্রের তোয়াক্কা না করে স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে প্রায় ৭ বছর ধরে যুবলীগের কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছিলেন ওমর ফারুক।
কার্যনির্বাহী বা প্রেসিডিয়াম বৈঠকও হতো তার খেয়াল-খুশি মতো।
এমনকী ৩ বছরের কেন্দ্রীয় কমিটি যেমন অর্ধযুগ পার করেছে, তেমনি মাত্র ৩ মাসের চট্টগ্রামের আহ্বায়ক কমিটি দায়িত্ব পালন করছে প্রায় ৬ বছর ধরে।
সরকারের শুদ্ধি অভিযানে ক্যাসিনো কেলেঙ্কারি, টেন্ডার বাণিজ্যসহ নানা অনিয়মের কবলে পড়ে চরম ইমেজ সংকটের মুখে পড়েছে যুবলীগ।
তৃণমূল থেকে শুরু করে কেন্দ্র পর্যন্ত- যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুকের বিরুদ্ধে অভিযোগের যেন শেষ নেই। নেতাদের অভিযোগ, সংগঠন পরিচালনায় যেমন তিনি স্বেচ্ছাচারিতার পরিচয় দিয়েছেন, তেমনি প্রশ্রয় দিয়েছেন অনিয়মের সঙ্গে সম্পৃক্তদেরও।
গত এক মাস ধরে চলা দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে ওমর ফারুকের অনুসারী হিসেবে পরিচিত ইসমাইল হোসেন সম্রাট, খালেদ ভূঁইয়া, জি কে শামীম, কাজী আনিসুল হকের নাম উঠে আসায় চরম ইমেজ সংকটে পড়েছে যুবলীগ।
শুধু রাজধানী নয়, বন্দরনগরী চট্টগ্রামসহ সারা দেশের যুবলীগে ছিল ওমর ফারুকের অনুসারীদের লাগামহীন নিয়ন্ত্রণ।
বিশেষ করে টেন্ডার বাণিজ্য এবং চাঁদাবাজির জন্য যুবলীগের এ অংশটিকে দায়ী করছে নেতৃত্বের বাকি অংশ।
সংগঠনের গঠনতন্ত্র মানার ক্ষেত্রেও ওমর ফারুকের ছিল চরম অনীহা। বিশেষ করে কার্যনির্বাহী কিংবা প্রেসিডিয়াম সদস্যদের বৈঠক ছিল অনিয়মিত।
ওমর ফারুকের ইচ্ছা অনুযায়ী এসব বৈঠক অনুষ্ঠিত কিংবা সিদ্ধান্ত নেয়া হতো বলেও অভিযোগ উঠেছে।
”এরশাদের আমলে যুব সংহতি করেন
ব্যবসা করে হন ঋণখেলাপি
২০০৯ সালে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান
২০১২ সালে চেয়ারম্যান
ওমর ফারুকের বয়স এখন ৭১ বছর”
সব মিলিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের ৭ম জাতীয় কংগ্রেস আয়োজনের জন্য আগামী ২৩ অক্টোবর তারিখ নির্ধারিত রয়েছে।
রোববার সম্মেলনের বিষয়ে চূড়ান্ত-দিকনির্দেশনা নিতে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে এই বৈঠকে বসেন কেন্দ্রীয় যুবলীগ।
তবে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে যেসব যুবলীগ নেতা বিতর্কিত হয়েছেন, তাদের বাদ দিয়ে বৈঠকে বসার ইঙ্গিত দেয়া হয়েছিল আগেই।
এমনকী পদ বাণিজ্যসহ নানা অভিযোগের কারণে খোদ যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীকেও বৈঠকে ডাকা হয়নি।
২০০৩ সালে ওমর ফারুক চৌধুরী যুবলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হন।
এর আগের কমিটিতে ছিলেন কার্যনিবার্হী কমিটির সদস্য। ২০০৯ সালে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।
এরপর ২০১২ সালে হন চেয়ারম্যান। এরপর থেকে যুবলীগে তার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।
ক্ষমতাসীন দলের যুব সংগঠনের শীর্ষ পদ পাওয়ার পর সম্পদ নিলামে ওঠার পরিস্থিতি সামলে নিয়েছেন এবং ধনাঢ্য জীবন-যাপন করছেন। যদিও তার দৃশ্যমান কোনো ব্যবসা নেই।
যুবলীগ চেয়ারম্যানের বর্তমান বয়স ৭১ বছর। তিনি ৭ বছর ধরে চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আছেন।
যদিও গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ৩ বছর পরপর কমিটি করার কথা। এ নিয়ে সংগঠনের নেতাকর্মীদের মাঝে সমালোচনাও আছে।
যুবলীগ সূত্রে জানা গেছে, চেয়ারম্যানের সঙ্গে তাদের সরাসরি আলাপ করার সুযোগও কম।
যুবলীগের দফতর সম্পাদক কাজী আনিসুর রহমানের মাধ্যমে তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়।
পিয়ন থেকে দফতর সম্পাদক হওয়া কাজী আনিসও ‘কমিটি বাণিজ্য’ করে অনেক বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়েছেন আনিস।
১৯৪৮ সালে জন্ম নেয়া ওমর ফারুক চৌধুরী সত্তরের দশকে চট্টগ্রাম জেলা বিড়ি শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
বিড়ি শ্রমিক লীগের নেতা হয়ে মিয়ানমার থেকে তামাকের বিকল্প টেন্ডু পাতা আমদানি শুরু করেন তিনি।
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় আসার পর ওমর ফারুক চৌধুরী শ্রমিক লীগের রাজনীতি ছেড়ে যোগ দেন জাতীয় পার্টির যুব সংহতিতে।
জাতীয় পার্টির প্রয়াত নেতা নাজিউর রহমান (মঞ্জু) এরশাদের মন্ত্রিসভার সদস্য হলে ওমর ফারুক দল বদল করেন।
জাতীয় পার্টির অঙ্গসংগঠন যুব সংহতির চট্টগ্রাম উত্তর জেলার রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন।
ওমর ফারুক চৌধুরী জাতীয় পার্টির প্রয়াত নেতা নাজিউর রহমান মঞ্জুর ভায়রা ভাই এবং আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিমের ভগ্নিপতি।
এরশাদ সরকারের পতনের পর কিছুদিন নীরব ছিলেন ওমর ফারুক। ১৯৯২ সালে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন হলে তিনি সদস্য হন। ১৯৯৭ সালে তিনি উত্তর জেলা কমিটির কোষাধ্যক্ষ হন।
চলমান আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরুর দিনই তার বক্তব্য ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
ক্যাসিনো ব্যবসার সঙ্গে যুবলীগের সম্পৃক্ততা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্যে নিজেই পড়ে যান বেকায়দায়।
এরইমধ্যে চলমান শুদ্ধি অভিযানের অংশ হিসেবে ওমর ফারুক চৌধুরীর ব্যাংক হিসাব তলব করে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট। দেশত্যাগের বিষয়েও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
অনেকে বলছেন, এমনই ভাগ্য ওমর ফারুকের, ৬৪ বছর বয়সে হয়েছেন যুবলীগের চেয়ারম্যান। অথচ যুবলীগের ইতিহাসে এর আগে ৫০ বছরের বেশি বয়সী কেউ চেয়ারম্যান হননি।
১৯৭২ সালের নভেম্বরে শেখ ফজুলল হক মণি যখন যুবলীগ প্রতিষ্ঠা করেন, তখন তার বয়স ছিল ৩২ বছর।