২৫শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১০ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৩শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

মনে তে ফাগুন এলো…

admin
প্রকাশিত ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০২০
মনে তে ফাগুন এলো…

Sharing is caring!

 

মোঃ মহিবুল ইসলাম / মোঃ মনির সরকার ::

 

বসন্ত মানেই ফুলের স্ফূরণ। চোখ ধাঁধানো রঙের সমাহার। আর তাই প্রকৃতির রূপ-সৌন্দর্যে মোহিত কবি গেয়ে ওঠেন— ‘এলো বনান্তে পাগল বসন্ত/ বনে বনে মনে মনে রং সে ছড়ায় রে, চঞ্চল তরুণ দুরন্ত।’

 

আজ (শুক্রবার, ১৪ ফেব্রুয়ারি) পহেলা ফাল্গুন। বসন্তের প্রথম দিন। মন কেমন করা অনুভবে বাঙ্ময় ঋতুরাজের আগমনী দিন আজ। এখন পলাশ-শিমুল-কৃষ্ণচূড়ার ডালে ডালে আগুনঝরা উচ্ছলতা। বনে নিভৃত কোণে, মেঠোপথের ধারে কারও দেখার অপেক্ষা না করেই ফুটেছে আরও কত নাম না-জানা ফুল।

 

চঞ্চল মনের আবেগের বিহ্বলতায় ছড়িয়ে প্রতি বছর বসন্ত আসে ভালবাসার ডাক ছড়িয়ে দেয়া কোকিলের কুহুতানে। এরই মধ্যে প্রকৃতিতে বসন্তের রং লেগেছে, তবে দিনপঞ্জির হিসেবে তার অভিষেক আজকের নতুন সূর্যের পিছু ধরে।

 

 

বাংলার নিসর্গ প্রকৃতিতে লেগেছে ফাগুনের হাওয়া। ফুলে ফুলে রঙিন হয়ে উঠেছে সবুজ প্রান্তর। তীব্রভাবে মনের মধ্যে আকুতি ছড়িয়ে দিচ্ছে যেন রবীন্দ্রনাথের গান— ‘ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান/আমার আপনহারা প্রাণ/আমার বাঁধনছেঁড়া প্রাণ/তোমার হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান/ তোমাকে অশোকে-কিংশুকে/ অলক্ষ্যে রং লাগল আমার অকারণে সুখ…।’

 

গাছে গাছে এসেছে আম্রমুকুল। সেখান থেকে ভেসে আসছে পাগলপারা ঘ্রাণ। এই ঘ্রাণেও প্রশান্তি। ঋতুরাজ বসন্তে কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, নাগলিঙ্গমের স্নিগ্ধ স্পর্শে জেগে উঠেছে যেন। প্রকৃতিতে চলছে মধুর বসন্তের সাজ সাজ রব। আর এ সাজে মন রাঙিয়ে অনেকেই গুন গুন করে গেয়ে উঠেছেন ‘মনে তে ফাগুন এলো…।’

 

 

আগুনরাঙা এই ফাল্গুনে অশোক-পলাশ-শিমুলের রং শুধু প্রকৃতিতেই উচ্ছ্বাসের রং ছড়ায় না।  ছড়ায় ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের শহীদদের রক্ত-রঙিন স্মৃতিরও ওপরও। বায়ান্নর ৮ ফাল্গুনের তথা একুশের পলাশরাঙা দিনের সঙ্গে তারুণ্যের সাহসী উচ্ছ্বাস আর বাঁধভাঙা আবেগের জোয়ার মিলেমিশে একাকার।

 

তাই বুঝি ফাগুন এলেই আগুন জ্বলে মনে। ফাগুন এলেই কোকিল ডাকে বনে। যখন বসন্ত জাগ্রত দ্বারে, তখন অশোক, রক্তকাঞ্চন, কনক লতা আর পলাশ-শিমুলের রঙ ছড়ানো দিনে কোকিলের ডাক উদাস করে দেয় আবেগ-বিহ্বল বাঙালির হৃদয়। ফুলের মঞ্জুরিতে মালা গাঁথার দিন বসন্ত কেবল প্রকৃতিকেই রঙিন করেনি, রঙিন করেছে আবহমান কাল ধরে বাঙালি তরুণ-তরুণীর প্রাণও।

 

 

ঋতুরাজ বসন্ত বাঙালি আর বাংলাদেশের মানুষের জীবনে নিয়ে আসে প্রেম ও বিদ্রোহের যুগল আবাহন। এমনই এক বসন্তে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা কারাগারে ‘ধূমকেতু’ প্রকাশের কারণে দেশদ্রোহের অভিযোগে আটকে রেখেছিল বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন ‘বসন্ত’ নামক গ্রন্থটি তাকে উৎসর্গ করে প্রকাশের মাধ্যমে নজরুলের সঙ্গে নিজের একাত্ম প্রকাশ করেছিলেন।

 

মহান গণঅভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ব অসহযোগ আন্দোলনও দানা বেঁধেছিল বসন্ত ঋতুতে। স্বাধীন বাংলাদেশেও গণতন্ত্রের দাবিতে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন বার বার পথ খুঁজে পেয়েছে বসন্তকালে। বসন্ত তাই বাঙালির জীবনে বাঁধনহারা হয়ে সৃষ্টির উল্লাসে প্রেমের তরঙ্গে ভাসার সময়। তাই নজরুলের কলম থেকে বেরিয়ে আসে, ‘এল খুলমাখা তূণ নিয়ে/খুনেরা ফাগুন…।’

 

রবিঠাকুরও লেখেন, ‘হাসির আঘাতে তার/ মৌন রহে না আর,/ কেঁপে কেঁপে ওঠে খনে খনে।’

 

 

বৃক্ষনিধন আর ফ্ল্যাট কালচারে নিষ্প্রাণপ্রায় এই কংক্রিটের নগরে— সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, রমনা পার্ক, মিন্টো রোড, বলধা গার্ডেন, চারুকলার পেছনের সবুজ প্রাঙ্গণ ফুলে ফুলে উচ্ছল-উজ্জ্বল এখনও বাসন্তী হাওয়ায়। এসব এলাকায় কোকিলের কুহুস্বরে মুখর পরিবেশে মন যেন কোনও উদাসলোকে হারিয়ে যেতে যায়। এ দিনে তরুণ-তরুণীদের প্রাণেও অনুরণিত হয় বাউল করিমের ভাষা, ‘বসন্ত বাতাসে সই গো, বসন্ত বাতাসে/ বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ আমার বাড়ি আসে।’ আর তাই মেয়েরা খোঁপায় গাঁদা-পলাশসহ নানা রকম ফুলের মালা গুঁজে বাসন্তী রঙের শাড়ি পরে এবং ছেলেরা পাঞ্জাবি-পায়জামা আর ফতুয়ায় শাশ্বত বাঙালির সাজে উৎসবের হাওয়ায় ভেসে বেড়াবে।

 

বসন্ত যেমন ফুল ফোটার তোয়াক্কা করে না, কোকিলও তেমন বসন্ত আসার অপেক্ষায় করে না। অমর একুশে গ্রন্থমেলায় গত কয়েকদিন ধরে কোকিলের ডাক শুনে বার বারই এ কথা মনে হয়েছে। প্রতি বসন্তের শুরুর দিনটিতে হাজারও বইপ্রেমী মানুষের সমাগমে জনারণ্যে পরিণত হয় মেলা প্রাঙ্গণ।

 

 

এবার কী বাদ থাকবে। প্রশ্নই আসে না। বসন্তের প্রথম দিনে অনেকেই প্রিয়জনকে বই উপহার দেন। এই একটি দিনটিকে ঘিরে থাকে অনেকের নানা পরিকল্পনা। তার অন্যতম গ্রন্থমেলায় আসা। প্রিয়জনের সঙ্গে বসন্তের মাতাল সমীরণে হারিয়ে যাওয়ার পর বইয়ের উৎসবে শামিল হওয়ার আনন্দটা কী কেউ মিস করে? বোধহয় না।

 

হাজারও তরুণ প্রাণ মেলায় আসবেন বই বসন্তে মেতে উঠবেন এটাই চান প্রকাশকরা। সেই ব্যবস্থা করেও রেখেছেন প্রকাশকরা। অপেক্ষা শুধু বেলা ১১টার। তারপরেই খুলে যাবে মেলার দ্বারগুলো। গ্রন্থমেলায় বইবে আনন্দের হাট। প্রমোদে হৃদয় ঢেলে দেয়ার তীব্র উচ্ছ্বাসে ফুলডোরে বাঁধা ঝুলনায় না হোক, হৃদয়ে হৃদয় বেঁধে দোল খাওয়ার উৎসবের পাশাপাশি মেলাপ্রাঙ্গণে ছড়িয়ে পড়বে বসন্তের সুবাতাস।