Sharing is caring!
মোঃ সামি উল্লাহ/টি.আই. অশ্রু,ঢাকা থেকে ::
মাত্র ২১ দিনের ধুন্ধুমার প্রচার-প্রচারণা শেষে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণের নগরপিতা নির্বাচনে ভোটের অপেক্ষায় এখন ঢাকাবাসী। শনিবার (১ ফেব্রুয়ারি) আগামী পাঁচ বছরের জন্য ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণের ভোটাররা বেছে নেবেন নিজ নিজ নগরপিতা।
গত ২১ দিনে নানা পন্থায় ভোটারদের মন জয় করার চেষ্টা চালিয়েছেন দুই সিটির মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকা মোট ১৩ প্রার্থী। নিজেদের উপস্থিতি প্রমাণে মেয়র প্রার্থীরা রাত-দিন একাকার করে ছুটে গেছেন ভোটারদের দ্বারে দ্বারে। পোস্টার-ফেস্টুন, ব্যানার-মাইকিং আর ডিজিটাল প্রচারণায় সরগরম রেখেছেন ভোটের মাঠ।
কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত নারী ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থীরাও পিছিয়ে থাকেননি একচুল। বরং অনেক ক্ষেত্রে ‘প্যারোডি গানে’ কাউন্সিলর প্রার্থীদের বাড়াবাড়ি প্রচারণায় রীতিমতো ‘বিরক্ত’ হয়েছেন ভোটাররা।
সিটি নির্বাচনে মেয়র, কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে টেক্কা দিতে মাঠে রয়েছেন বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা। পাশাপাশি জাতীয় পার্টি, সিপিবি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, এনপিপি, পিডিপি, গণফ্রন্ট ও বাংলাদেশ কংগ্রেস নামের নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলও মেয়র পদে প্রার্থী দিয়েছে।
বিগত দিনের উন্নয়নের কর্মকাণ্ডসহ একটি পরিকল্পিত সুন্দর ও আধুনিক ঢাকা গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বেশিরভাগ প্রার্থী। আধুনিক ও টেকসই নগরী গড়তে ডেঙ্গু, জলাবদ্ধতা ও যানজটসহ নানা সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন তারা। ঢাকাকে বসবাসযোগ্য, উন্নত করে গড়ে তোলা এবং চলমান উন্নয়ন কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের মেয়র প্রার্থীরা।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র প্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপস ও বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থী ইশরাক হোসেনের মধ্যে মূল লড়াইটা হবে।
উত্তরে লড়াই হবে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আতিকুল ইসলাম ও বিএনপির তাবিথ আউয়ালের মধ্যে।
নির্বাচনি বিধিমালা অনুযায়ী ভোটের ৩২ ঘণ্টা আগে প্রচারণায় নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। সে হিসাবে বৃহস্পতিবার রাত ১২টার পর নির্বাচনি এলাকায় কোনও ব্যক্তি কোনও জনসভা আহ্বান, অনুষ্ঠান বা তাতে যোগদান করা এবং কোনও মিছিল বা শোভাযাত্রা সংগঠিত বা তাতে যোগদান করতে আর পারবেন না।
প্রচারণার শেষ দিনে বৃহস্পতিবার (৩০ জানুয়ারি) ঢাকা দক্ষিণ সিটির গোপীবাগে ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাবে নির্বাচনি প্রচারণা করেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের মেয়র প্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপস। দুপুর ১২টা থেকে শেখ ফজলে নূর তাপসের প্রচারণা শুরু হওয়ার কথা থাকলেও সকাল থেকেই ঢাকা দক্ষিণ সিটির নৌকা প্রতীকের কর্মী-সমর্থকরা ট্রাক-পিকআপ ও মোটরসাইকেলযোগে মিছিল করতে শুরু করেন। পরে দুপুর সাড়ে ১২টায় নির্বাচনি প্রচারণায় অংশ নেন শেখ ফজলে নূর তাপস।
গণসংযোগের আগে ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাবে এক সংক্ষিপ্ত পথসভায় তাপস বলেন, আমরা যে ইশতেহার ও প্রতিশ্রুতি নিয়ে জনগণের দ্বারে দ্বারে গিয়েছি সেই প্রতিশ্রুতি ও ইশতেহার জনগণ গ্রহণ করেছে। তিনি গোপীবাগ এলাকায় দল-মত নির্বিশেষে সবার কাছে নৌকা প্রতীকে ভোট প্রার্থনা করেন।
ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে বিএনপির মনোনীত ধানের শীষ প্রতীকের মেয়র পদপ্রার্থী ইশরাক হোসেন সকালে কোনও ধরনের নির্বাচনি প্রচারণায় অংশগ্রহণ না করলেও তার কর্মী ও সমর্থকরা ধানের শীষের পক্ষে নির্বাচনি প্রচারণা চালিয়েছেন। ইশরাকের পক্ষে ভোট প্রার্থনা করেন অবিভক্ত ঢাকার সাবেক মেয়র প্রয়াত সাদেক হোসেন খোকার স্ত্রী ও ইশরাক হোসেনের মা। এ সময় গণসংযোগ করেন ইশরাক হোসেনের ছোটভাইও।
সকালে প্রচারণায় না থাকলেও বিকেল তিনটা থেকে শেষ সময়ের প্রচারণায় সরাসরি অংশ নেন ইশরাক হোসেন।
তিনি প্রচারণায় অংশগ্রহণ করার আগে নির্বাচনি কার্যক্রমের অংশ হিসেবে দলীয় জ্যেষ্ঠ নেতা-কর্মী ও মিত্র স্থানীয় কূটনৈতিক ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে সাক্ষাৎও করেন।
সকাল ১০টায় রাজধানীর ভাসানটেক বাজার এলাকা থেকে নির্বাচনি প্রচারণা শুরু করেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নৌকা মনোনীত মেয়র প্রার্থী আতিকুল ইসলাম। এ সময় তার সঙ্গে প্রচারণায় অংশ নেন এক ঝাঁক চলচ্চিত্র ও নাট্যশিল্পী।
শেষ দিনের প্রচারণায় এই প্রার্থী বলেন, পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করে ভাসানটেক বস্তি থেকে আর একটি মানুষকেও উচ্ছেদ করা হবে না। বস্তিতে যারা থাকেন তারাও মানুষ। আমাদের কাজ হচ্ছে মানুষের মৌলিক চাহিদা ও সুবিধাগুলো তাদের কাছে পৌঁছে দেয়া। তাই কথা দিচ্ছি, আপনাদের ভোটে যদি মেয়র নির্বাচিত হতে পারি তাহলে আগে পুনর্বাসনে ব্যবস্থা করব তারপর বস্তি খালি করা হবে।
বক্তব্যে তিনি প্রচারণার শুরু দিন দেকে শেষ দিন পর্যন্ত গণসংযোগ ও প্রচারণায় গণমাধ্যমকর্মীদের ভূমিকার কথা তুলে ধরে তাদের প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানান।
জাতীয় প্রেস ক্লাবে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ের মাধ্যমে শেষ সময়ের নির্বাচনি প্রচারণা করেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের বিএনপি মনোনীত ধানের শীষ প্রতীকের মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়াল। মতবিনিময়কালে তিনি বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষে দেশবাসী আগামী ৪৮ ঘণ্টা নির্বাচন কমিশনের দিকে তাকিয়ে থাকব। এখনও নির্বাচনের দিন ঘিরে শঙ্কা রয়েছে। পোলিং এজেন্টরা কেন্দ্রে থাকতে পারবে কিনা- তা নিশ্চিত নই। ইভিএমের বিষয়টা নিয়ে এখনও অনিশ্চয়তা আছে। নির্বাচনে কোনও অভিযোগ, সংঘর্ষ আসলে মোকাবেলায় নির্বাচন কমিশন ইতিবাচক প্রস্তুত কিনা? তবে আমরা ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে এগুচ্ছি। নির্বাচন কমিশনের ভূমিকার ওপর নির্ভর করে নিবার্চন কেমন হবে।
প্রেস ক্লাবে সাংবাদিক নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় শেষ করে তিনি ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আরও একটি মতবিনিময় সভায় যোগ দেন। শেষে কারওয়ানবাজার ও ফার্মগেট এলাকায় গণসংযোগ করেন তাবিথ আউয়াল।
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটির ভোট অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করতে সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ভোট সুষ্ঠু করতে বৃহস্পতিবার (৩০ জানুয়ারি ) সকাল থেকেই মাঠে নেমেছে বিজিবিসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
যানবাহন চলাচলের ওপর জারি করা হয়েছে নিষেধাজ্ঞা।
নগরীর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে বসানো হয়েছে বিশেষ নিরাপত্তা চৌকি। নিরাপত্তার চাঁদরে ঢেকে দেয়া হয়েছে পুরো রাজধানী। ভোটারদের নিরাপত্তা আর ভোটদান নির্বিঘ্ন করতে পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকেও নেয়া হয়েছে তিন স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও আনসার মিলে প্রায় ৫০ হাজারের মতো আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থাকছে নির্বাচনি মাঠে। সাথে থাকছেন ১২৯ জন জুডিশিয়াল ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।
দুই সিটিতে মোট প্রিজাইডিং আফিসার থাকবে ২৪৬৮ জন, সহকারী প্রিজাইডিং থাকবে ১৪ হাজার ৪৩৪জন পোলিং আফিসার থাকবে ২৮ হাজার ৮৬৮ জন।
কারিগরি সহায়তায় (সেনাবাহিনী) থাকবে ৪ হাজার ৯৩৬ জন। সব মিলে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা থাকবে ৫০ হাজার ৭০৬ জন।
ইসি কর্মকর্তারা জানান, দুই সিটিতে আইন-শৃঙ্খলায় থাকবে পুলিশ মোবাইল টিম ১২৯০ জন, পুলিশ স্টাইকিং ৪৩০, পুলিশ রিজার্ভ ৫২০, র্যাব ১৪৩০ জন, বিজিবি ২২৫০, ভোটকেন্দ্র ফোর্স থাকবে ৪১ হাজার ৯৫৬ জন, মোট ৪৭ হাজার ৮৭৬ জন। থাকবে নৌপুলিশ।
ভোটের দুই দিন আগে ৩০ জানুয়ারি থেকে ১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চার দিনের জন্য দায়িত্ব পালন করবে মোবাইল ও স্ট্রাইকিং ফোর্স। দুই সিটি ভোটকে সামনে রেখে ‘আইন -শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েন’ সংক্রান্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রে এ তথ্য জানানো হয়।
২২ ডিসেম্বর (রোববার) ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। এরপর ১০ জানুয়ারি (শুক্রবার) প্রতীক বরাদ্দ দেয়ার পর প্রচারে নেমে পড়েন প্রার্থীরা।
দুই সিটিতে ১৩ মেয়র প্রার্থীসহ কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন প্রায় সাড়ে ৭০০ প্রার্থী। ৫৪টি সাধারণ ওয়ার্ড ও ১৮টি সংরক্ষিত মহিলা ওয়ার্ড নিয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) গঠিত। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) রয়েছে ৭৫টি সাধারণ ওয়ার্ড ও ২৫টি সংরক্ষিত ওয়ার্ড। দুই সিটিতে ৫৪ লাখ ৬৩ হাজার ৪৬৭ জন ভোটার রয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটিতে মোট ভোটার রয়েছেন ৩০ লাখ ১০ হাজার ২৭৩ জন। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ভোটার রয়েছেন ২৪ লাখ ৫৩ হাজার ১৯৪ জন।
ভোট উপলক্ষে ১ ফেব্রুয়ারি দুই সিটি এলাকায় এরই মধ্যে ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত চলবে টানা ভোটগ্রহণ।
প্রথমবারের মতো ঢাকা সিটির পুরো ভোটগ্রহণ হবে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন-ইভিএমে।